" ওরাও মানুষ "
............ জয়নব জোনাকি।
রাত গভীর থেকে গভীর হচ্ছে তবুও সায়লার চোখে ঘুম নেই। বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে নিজের চোখে দেখে আশা সেই নির্মম দৃশ্য !!
পথের পাশেই ছিন্নমূল হতদরিদ্র শিশুটি কাঁদছে আর তার সমস্ত ঘৃণা ক্ষোভ ও ভাষাহীন অবুঝ শক্তির চাহনি দিয়ে মা হারানোর বেদনা মানুষকে বুঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। উৎসুক পথচারী
সবাই একটুখানি দেখে যে যার গন্তব্যের দিকে ছুটছে।
এই ছোট্ট শিশুটির আর্তনাদ যেন কেউ শুনতে পাচ্ছেনা। চোখ কান হাত পা থেকেও আজ যেন তারা অন্ধ বধীর অচল এক প্রাণহীন জড় পদার্থ। কিন্তু কেন ?? কেন আজ মানুষের হাতেই মানুষকে প্রাণ দিতে হয় ? মায়া মমতা প্রেম ভালবাসা বোধ এই মানুষ গুলো কেন এতো হিংস্র ? কোথায় আজ তাদের মানবতার বুলি? কার কাছে আজ এসব বন্ধক দিয়েছে মানুষ নামের সুন্দর আকৃতির শ্রেষ্ঠ জীব গুলো ?? হাজারো প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পায়না সায়লা। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো সায়লা। এমন সময় সায়লার মা রাশিদা বেগম এসে মেয়ের পাশে বসে বললেন এতরাতেও তুমি ঘুমাওনি সকালে কলেজে যেতে হবে তোমাকে শরীর খারাপ করবে যে ! একটা সামান্য দুর্ঘটনাকে মনের মধ্যে জিইয়ে রেখে রাত জেগে শরীর খারাপ করার মানে হয়না। ওরা ছিন্নমূল ওদের সামাজিক স্ট্যাটাস নেই ওদের নিয়ে এভাবে ভাবতে গেলে তোমার ক্যারিয়ার বাধাগ্রস্ত হবে। মায়ের কথায় সায়লা ভেতরে ভেতরে রেগে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল। মা ওরাও মানুষ ! ওদেরও আছে আমাদের মত রক্ত মাংস, ওদেরও সুখ দুঃখ অনুভূতি আছে। ওরা হতদরিদ্র ছিন্নমূল বলে আমাদের মত ওদেরও এ সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার আছে। গরীব ছিন্নমূল বলে কি ওদের বাঁচার অধিকার ও বিচার পাবার কি অধিকার নেই ? তবে কি আমাদের মানবাধিকার উঁচুনিচু অর্থবিত্ত ধর্ম বর্ণ আর ক্ষমতার ভেধে রচিত হয়!? মানবতাবোধ কি শুধু নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য? যে শিক্ষা আমাকে মানুষকে ভালবাসতে দেয়না যে শিক্ষা আমাকে পশু ও মানুষের সমাজের পার্থক্য বুঝায়না সেই শিক্ষা আমার জন্য অহেতুক ও নিষ্প্রয়োজন মনে করি।
কারণ পশুরও মানুষের মত ক্ষুধা পেলে খায় বাচ্ছা প্রসব করে জৈবিক চাহিদা মেটায় প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয় শক্তি মত্তা দিয়ে প্রতিপক্ষকে গায়েল করে। আর এই মিল গুলোর মধ্যে পশুর সাথে আমি পার্থক্য খুঁজে পাই মানুষের মত তাদের শিক্ষার বোধ জাগেনা জ্ঞানচর্চা করতে পারেনা বলেই মানুষ জগতের শ্রেষ্ঠ হয়েছে। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই মানুষ মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অন্যসব প্রাণীর উপর কর্তৃত্ব করতে পারে। আর এই কর্তৃত্ব মানে পেশীর জোরে অর্থ ক্ষমতার জোরে মানুষকে খুন করা বা উঁচুনিচু পার্থক্য করে বৈষম্যের মাধ্যমে এই বসুন্ধরাকে উত্তপ্ত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা নয় ! যতক্ষণ এই মানুষের মাঝে সঠিক ও নির্ভুল জ্ঞান না ঢুকানো যায় ততোক্ষণ সে দেখতে মানুষ হলেও সত্যিকারের জীবন্ত মানুষ হয়ে উঠেনা।
রাশিদা বেগম খুব স্মার্ট ও বর্তমান সময়ের অতি আধুনিকা প্রগতিশীল হলেও নিজের মেয়ের কাছে মানবতার প্রাঞ্জল শিখামূলক কথা শুনে রাশিদা বেগম কিছুটা লজ্জিত ও বিব্রত হবার পাশাপাশি তার ঘুমন্ত বিবেক জেগে উঠে। প্রচণ্ড ভাবে নাড়া দেয় তার পাশ্চাত্যের ধার করা চিন্তা গুলো। যে চিন্তা কে এতদিন আধুনিক শিক্ষার উপজীব্য মনে করতো সেই স্বার্থপর চিন্তার পর্দাগুলো ধিরে ধিরে সরে সুন্দর একটা বৈষম্য মুক্ত মানুষের পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে লাগলো। হঠাৎ মুয়াজ্জিনের সুরেলা মধুর কণ্ঠের আজান ভেসে আসলো। আর এই সুর যেন রাশিদা বেগম আজই হৃদয় দিয়ে অবুভব করতে লাগলো। নতুন এক পৃথিবীর হাতছানি রাশিদা বেগমকে উদ্বেলিত করতে লাগলো। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে এল। অজু করে মা মেয়ে দুজনেই সিজদায় লুটিয়ে পড়লো।
---------------সমাপ্ত-----
১৫/১১/২০১৫ ইং