- শাবাব মুস্তাফা
আমরা নানা সময়ে কমবেশি কিছু না কিছু পড়ে চলেছি। সেটা খবরের কাগজ হোক, বিজ্ঞাপনের রঙ-চঙে বিলবোর্ড হোক, পাঠ্যপুস্তকের লেখা হোক কিংবা নামী কোন লিখিয়ের বই-ই হোক। এই লেখাগুলোর আকার একেকটার একেক রকম। কোনটা এক লাইনের, কোনটা এক পৃষ্ঠার, কোনটার আবার পৃষ্ঠার সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি। এই যে এত রকম লেখা আমরা পড়ছি এর একেকটার মেজাজ, ঢং, স্বাদ একেক রকম। কিন্তু এতসব লেখার মধ্যে কিছু লেখা আছে যা, আমরা আনন্দের সাথে পড়ে চলি। অন্তর্নিহিত বক্তব্য পড়ামাত্রই আমরা উপলব্ধি করতে পারি। লেখাগুলো আমাদের চিন্তার দুয়ার খুলে দেয়, পুরনো জিনিস নতুন করে দেখতে শেখায়। আবার কিছু লেখা আছে পড়তে আমাদের মোটেই আরাম লাগে না। এক লাইন পড়বার পর পরের লাইন পড়ার আগ্রহ আমরা পাই না। তারপরও যদিও একটু কষ্ট স্বীকার করে পড়েই ফেলি, শেষপর্যন্ত হয়তো দেখা গেল লেখাটিতে লেখক আসলে কি বোঝাতে চেয়েছেন সেটা কেমন পরিষ্কার হলো না, ধোঁয়াশে রয়ে গেল।
প্রথম ধরণের লেখাগুলো চমৎকার লেখা। একবার পড়বার পর বার বার পড়তে ইচ্ছে করে। সাধারণভাবে এগুলোকে আমরা ভালো লেখা বলি।
ভালো লেখা আসলেই কাকে বলে?
সাহিত্যের প্রায় আদিকাল থেকেই নানা গুণীজন নানাভাবে কী কী গুণ থাকলে সাহিত্যকে কিংবা কোন রচনাকে ভালো বলা চলে সেগুলোকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। কারো মতে ভালো লেখা হতে হলে, লেখায় লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছ প্রতিফলন থাকতে হবে, বিস্তারিত বর্ণনা এবং যুক্তি থাকতে হবে। লেখক নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পাঠকের সামনে শুধুমাত্র পেশ করবেন, চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন না। কেউ বলছেন, যে লেখা সহজেই পাঠকের বোধগম্য হবে, যে লেখাটি পড়ে পাঠকের মনে আনন্দভাব জাগ্রত হবে, যার বর্ণনা পড়ে ঘটনার কল্পনা পাঠকের চোখে ভাসবে সেটা ভালো লেখা। আবার কেউ কেউ বানান এবং ব্যকরণের উপর জোর দিয়ে বলেছেন, শুদ্ধ বানান আর ব্যকরণ না থাকলে রচনাই বৃথা।
তবে মূলকথাটা সম্ভবত সবচেয়ে সহজ করে বলেছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, 'ভালো বই কাকে বলে?' উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'যে বইটা পাঠককে ভাবায়, সেটাই ভালো বই।' তার বক্তব্যের সূত্র ধরে আমরাও বলতে পারি, 'যে লেখাটি পাঠককে ভাবাবে, সেটাই ভালো লেখা।'
লেখালিখি করার প্রয়োজনটা কী?
বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমান বিশ্বে মনের ভাব প্রকাশ করার আমাদের মাধ্যম অনেক। কিন্তু এদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকরী এবং সবচেয়ে সৃজনশীল মাধ্যম হচ্ছে ভাষার লেখ্যরূপ। এর পেছনেও কিন্তু আছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। আমরা জানি আমাদের মস্তিষ্কে দুটো বলয় রয়েছে। ডান বলয় আর বাম বলয়। ডান বলয় নিয়ন্ত্রণ করে কল্পনা, আবেগ, বিশ্বাস, সৃজনশীলতা, অতিচেতনা, আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক ভাবনা ইত্যাদি। আর বাম বলয় নিয়্ন্ত্রণ করে কথা, শ্রুতি, অঙ্ক, যুক্তি, ভাষা-র মতো জিনিসগুলো। এখন আমরা যখন আমাদের নিজেদের বিশ্বাসের কথা, কিংবা কোনো পরিকল্পনার কথা (চিন্তায় যা আমরা সুবিন্যস্তভাবে কল্পনা করি) যুক্তির নিরীখে, সুন্দর ভাষায় লিখছি তখন কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের দুটো বলয়ে চমৎকার সমন্বয়ের সাথে কাজ করতে শুরু করে। ফলে আমরা আমাদের মস্তিষ্ককের ক্ষমতাকে আরো বেশি করে, আরো সুষমভাবে কাজে লাগাতে পারি। ফলে দেখা যায় আমরা যখন কোন কিছু লিখতে শুরু করি, নতুন নতুন ভাবনা, নতুন নতুন চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি, যুগান্তাকারী আইডিয়া আমাদের মাথায় আসে। আমাদের মধ্যে যাদেরই কমবেশি কিছু না কিছু লেখার অভ্যাস রয়েছে তারা নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে একমত হবেন।
লেখালিখি ফলে আমাদের আরো একটা জিনিস খুব চমৎকারভাবে বিকশিত হয়, সেটা হচ্ছে আমাদের পর্যবেক্ষণী ক্ষমতা। চিন্তার পরিধি বাড়ায় দেখা যায় কোনো একটি সাধারণ ঘটনার ভেতরের আসাধারণ কিছু জিনিস আমরা দেখতে পাই। জানা জিনিসগুলোকে আমরা নতুনভাবে উপলব্ধি করতে পারি। মুক্তবুদ্ধির চর্চার কারণে দৃষ্টির সীমাটা আমাদের দিন দিন প্রসারিত হতে থাকে। চারপাশের পুরো জগতের যেন একটা নতুন মানে আমরা খুঁজে পাই। এবং এই উপকারটা যে শুধুমাত্র যিনি লিখছেন শুধু তিনিই পাচ্ছেন না। যিনি লিখছেন আর যিনি লেখা পড়ছেন, দুজনেই আলোকিত হচ্ছেন।
এছাড়াও আরো বেশ কিছু উপকারের মধ্যে আরো একটা উল্লেখযোগ্য উপকার হচ্ছে নিজের যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি। আমাদের মাঝে খুঁজলে এরকম অনেককেই পাওয়া যাবে যার মনের দুঃখ হচ্ছে, অন্য কেউ একজন তার কথা বুঝছে না। কোয়ান্টামে আমরা জানি, 'ও আমাকে বুঝল না' -এর অর্থ হচ্ছে, 'আমিই তাকে বোঝাতে পারলাম না'। আপনি যখন সক্রিয়ভাবে পাঠকদের আপনার কথা সহজে বোঝানোর জন্য আপনার মস্তিষ্কটাকে খাটাতে শুরু করবেন, আপনি বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করবেন, আপনার আশেপাশের লোকজনকেও আপনার কথাগুলো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারার সৃজনশীলতা আপনি রপ্ত করে ফেলেছেন। আপনি লক্ষ্য করবেন আপনার কথা লোকজন মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আপনি অনুভব করবেন আগের চাইতে অনেক বেশি গুরুত্ব আপনি পাচ্ছেন।
লিখব বটে, কিন্তু লিখবটা কী?
রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন, 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু'। আমরা সবাই এটা পড়েছি এবং মহা উৎসাহে বইয়ে লেখা সারমর্ম কষে মুখস্ত করে পরীক্ষায় গিয়ে লিখে এসে চমৎকার চমৎকার সব নম্বর নিয়ে এসেছি। কিন্তু কী মুখস্ত করেছি আর কী লিখেছি তার কিছুই বুঝিনি। ফলে আমাদের আর সিন্ধুও দেখা হয়নি আর বিন্দুর মধ্যে কী লুকিয়ে আছে সেটাও খোঁজা হয় নি। লেখার বিষয়বস্তু নির্ধারণের ব্যাপারটাও অনেকটা ওইরকমই।
লেখার জন্য নিজের অভিজ্ঞতার চাইতে চমৎকার বিষয় খুব কমই আছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই প্রথম ভুলটা করি এখানেই। নিজের অভিজ্ঞতার চাইতে আমরা হয়তো লেখার জন্য বেছে নিই কাল্পনিক কিছু একটা। যার ফলাফলটা মোটেই ভালো দাঁড়ায় না। এবং আমরা ফলাফল দেখে হতোদ্যম হয়ে পড়ি। অথচ আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা এমনই বিষয় যেটা আমাদের চাইতে ভালো করে আর কেউ বলতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত আরেকটা বিষয়, যেটাকে আমরা প্রায়ই অবহেলা করি, হচ্ছে আমাদের পেশাগত ক্ষেত্রে পাওয়া জ্ঞান কিংবা অভিজ্ঞতা। আমরা বেশিরভাগ সময়ই এটাকে লিখবার জন্য একটি চমৎকার বিষয়বস্তু হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি না। অথচ একটু ভাবলেই দেখতে পাবো যে আমাদের নিজেদের পেশাগত ক্ষেত্রে আমাদের যে অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান রয়েছে সেটা কিন্তু অধিকাংশ মানুষেরই নেই। এটাও লেখার চমৎকার বিষয় হতে পারে।
লেখা যে সবসময় নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই হতে হবে বা ফিকশন জাতীয় হতে হবে এমন নিয়ম কিন্তু কেউ বেঁধে দেয় নি। ভ্রমণ কাহিনী, ছোট-বড় গল্প, কবিতা; এগুলো যেমন লেখার বিষয় হতে পারে, তেমনি সমসাময়িক পরিস্থিতির পর্যালোচনা, নতুন কোনো আইডিয়া, নিজের শিক্ষাগত বিষয় নিয়ে আলোচনা, সংবাদের পর্যালোচনা ইত্যাদিও লেখার চমৎকার বিষয় হতে পারে।
শুরু করব কোথা থেকে?
খুব ছোট্ট ঘটনা থেকেও শুরু হতে পারে। যেমন ধরুন-
আপনি গাড়িতে করে যাচ্ছেন। গাড়িটা চলতে চলতে একসময় সিগন্যালে থেমে গেল। গাড়ির জানালা দিয়ে ছোট্ট একটা হাত ঢুকে গেল ভেতরে। হাতে ধরা টকটকে লাল, তাজা চমৎকার ক'টা গোলাপ ফুল। পাঁপড়ির ওপর দুয়েকটা পানির ফোঁটায় রোদের সোনালি ঝিলিক। অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য।
হঠাৎ ফুলগুলো ধরে রাখা মেয়েটার দিকে আপনার নজর যেতে আপনি একটা ধাক্কামতো খেলেন। মলিন চেহারার একটা মেয়ে। তারচেয়ে মলিন তার পোশাক। খড়ের মতো চুলগুলোয় শেষ কবে তেলপানি পড়েছিল তা কে জানে! আসামান্য সৌন্দর্যের সওদাগর হচ্ছে অতিসামান্য, অতিমলিন একটি শিশু। মেয়েটাকে দেখে আপনার খুব মায়া লাগছে। আপনি ব্যাগ হাতড়ে মোটামুটি বড় একটা নোট মেয়েটাকে দিয়ে বললেন, পুরোটাই রাখ, ফেরত দিতে হবে না।
আনন্দে মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেলো। সাদা দাঁতের ঝলকানিতে আপনি আবারও বিস্মিত হয়ে পড়লেন। অতি অদ্ভুত সুন্দর সেই হাসি। মুহূর্তে জন্য আপনি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন, কোনটা বেশি সুন্দর? আপনার হাতের গোলাপগুলো, নাকি বাইরের মলিন আবরণের পেছনের ওই নির্মল হাসিটুকু?!
সিগন্যাল বাতি বদলে সবুজ হয়ে গেছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আর আপনি তাতে বিহ্বল হয়ে বসে আছেন।
খুব সাধারণ একটা ঘটনা। এইরকম আরো শত শত ঘটনা আমাদের জীবনে প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে। আপনার মনে হচ্ছে এইসব লেখা কি আর মানুষ পড়বে?! লিখেই ফেলুন না। তারপর নিজেই একবার পড়ে দেখুন। আপনি বিস্মিত হবেন। দেখবেন নিজের লেখা পড়তে নিজেরই ভালো লাগছে।
লেখনভঙ্গির সাধারণ ছক
আসলে লেখার জন্য নির্দিষ্ট কোনো ছক নেই। কোনো ছকে ফেলা সম্ভবও নয়। তবে শুরুর দিকে লেখাটাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে নিলে সামনের দিকে এগুতে সুবিধা হতে পারে। একটা লেখার মূল অংশগুলোকে আমরা মোটামুটি পাঁচটা ভাগে ভাগ করে নিতে পারি।
• ভূমিকা/ প্রেক্ষাপট
• ঘটনা/ বর্ণনা
• পর্যবেক্ষণ
• মতামত/ উপলব্ধি
• উপসংহার/ শেষকথা
১। ভূমিকা : অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে 'ভূমিকা' শব্দটি শোনার সাথে সাথে আমাদের অবচেতন মনে ভেসে আসে, 'আলোচ্য অংশটুকু অমুক রচিত তমুক প্রবন্ধের তিন নম্বর প্যারার পাঁচ নম্বর লাইনের শেষ দিকে থেকে চয়ন করা হয়েছে...'।
আমরা যেহেতু বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিচ্ছি না তাই এইরকমটা না লিখলে নম্বর কাটা তো যাবেই না, বরং না লিখলেই বেশ কিছু নম্বর বেশি পাওয়ার সম্ভবনা আছে!
ভূমিকা অংশে ঘটনার শুরুর কিছুর কথা থাকতে পারে। যাতে যিনি পড়ছেন, তিনি ঘটনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একটা ধারণা পান। পরের ঘটনাগুলো সহজেই রিলেট করতে পারেন।
২। ঘটনা/ বর্ণনা : এই অংশে সাধারণত মূল ঘটনাটার বর্ণনা থাকে। কী ঘটেছিল, কীভাবে ঘটেছিল, কী কারণে ঘটেছিল ইত্যাদি বিষয়গুলো থাকে এই অংশে।
৩। পর্যবেক্ষণ : ঘটনাটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন, কী কী আপনার নজরে এলো, কী নিয়ে ভাবলেন সেগুলো থাকতে পারে এই অংশে।
৪। মতামত/ উপলব্ধি : এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতে আপনি কী সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন বা কী কী উপলব্ধি করলেন সেটা এই অংশে থাকতে পারে।
৫। উপসংহার : শেষ বক্তব্য কিংবা ঘটনা শেষে কী ঘটলো সেটা এখানে লেখা যেত পারে। চুড়ান্ত উপলব্ধি বা মতামতও এখানে থাকতে পারে।
আমরা যেহেতু পরীক্ষার খাতায় রচনা লিখছি না, অতএব লেখার মধ্যে এই পয়েন্টের নামগুলো উল্লেখ করার কোনোই প্রয়োজন নেই।
এই ক্রমই অনুসরণ করতে হবে?
এই ক্রমই অনুসরণ করতে হবে এমন কোন কথা নেই। ক্রমগুলো আগুপিছু হতেই পারে। মোটকথা সৃজনশীলতার 'সীমা' বলে কিছু নেই। নতুন কোনো ছকে, নতুন কোনো ঢংয়ে আপনি আপনার লেখা লিখতেই পারেন।
সুখপাঠ্য লেখার আরো কিছু বৈশিষ্ট্য
১। প্রাঞ্জলতা : বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী যখন প্রকাশিত হয় তখন বঙ্কিমচন্দ্রের বয়স মাত্র ২৭। তার দুর্ভেদ্য ভাষার গঠন সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। বঙ্কিম তার জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে, ১৮৮০ দশকের শেষদিকে লেখা 'সহজ রচনাশিক্ষা' বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় ভাগে গিয়ে বলেছেন, “যাহা লিখিলে, লোকে যদি তাহা না বুঝিতে পারিল, তবে লেখা বৃথা।” (এই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাঠ এবং তৃতীয় পাঠের সংকলন আমরা 'রচনার শিল্পগুণ' নামে নবম-দশম শ্রেণীর গদ্য সংকলন বইতে পড়ে থাকি)। সত্যি সত্যিই যাদের উদ্দেশ্যে লেখা তারা না বুঝলে লেখাই বৃথা।
২। বর্ণনার ধারাবাহিকতা : বর্ণনার মধ্যে ধারাবাহিকতা থাকলে পাঠকে সহজেই মূলভাব ধরতে পারেন। একটি ঘটনার বর্ণনা দিতে দিতে অপ্রাসঙ্গিক অন্য ঘটনায় অনেকখানি চলে গিয়ে, মাঝখান থেকে হঠাৎ করে আগের জায়গায় ফিরে এলে বেশিরভাগ পাঠকের ক্ষেত্রেই খেই হারিয়ে যায়। পাঠক পড়ে আরাম পান না। মাঝে মাঝে মূল লেখার ভাবে ফিরে আসা সময়ে সময়ে লেখকের জন্যও কঠিন হয়ে পড়ে। তাই বর্ণনার ধারাবাহিকতা থাকলে সেটা পাঠক এবং লেখক উভয়ের জন্যই সুবিধাজনক।
৩। বিনীত প্রকাশভঙ্গি : বিনয় এমন একটা জিনিস যা একটি সাধারণ লেখাকেও অসাধারণত্ব দিতে পারে। বিনয় পছন্দ করেন না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে। যিনি লিখছেন তিনি হয়তো পাঠকের চাইতে কোনো একটা বিষয়ে কিছুটা হলেও বেশি জানেন। জ্ঞানের বিনীত প্রকাশই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানীর লক্ষণ।
৪। শুদ্ধ বানান ও শুদ্ধ ব্যকরণ : কল্পনা করুন আপনি আপনার সবচেয়ে প্রিয় গানটি ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজাচ্ছেন। কিন্তু তার ফিতেটা প্রতি ১০ সেকেন্ড অন্তর অন্তর আটকে যাচ্ছে। আপনার কাছে কি আপনার সবচেয়ে প্রিয় গানটাও আর শুনতে ভাল লাগবে?!
ভুল বানানে লেখা কোনো কিছু পড়তে গেলে পাঠকেরও একই রকম দশা হয়। ভুল বানান থেকে শুদ্ধ শব্দটি আন্দাজ করে নিয়ে বা ভুলভাবে গঠিত বাক্যের অর্থ বুঝতে গিয়ে পাঠককে এত বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় যে লেখার মূলভাবটা আর পাঠকের কাছে ধরা দেয় না।
ভুল বানানে লেখা কিছু পড়তে গিয়ে পাঠক আনন্দ তো পান-ই না বরং উল্টো আরো অনেকখানি বিরক্তবোধ করেন। আমরা কেন বানানগুলো ভুল করি এটা নিয়ে আমরা পরবর্তী সেশনে আরো বিস্তারিত আলোচনা করো।
৫। নিজের লেখা নিজেই আবার একটু পড়ে দেখার অভ্যাস : এটি একটি চমৎকার অভ্যাস। বেশিরভাগ সময়ই লেখার পর আমরা নিজের লেখা আর দ্বিতীয়বার পড়ার প্রয়োজন অনুভব করি না। অথচ লেখার মধ্যের ত্রুটিগুলোর প্রায় শতকরা ৬০ থেকে ৯০ ভাগ ভুলগুলো শনাক্ত করতে পারি প্রথমবার পড়েই। অতএব, পাঠককে পড়তে দেবার আগে নিজেরাই একটু পড়ে দেখতে পারি যে নিজের লেখাটি নিজের কাছে পড়তেই কেমন লাগে।
লেখনভঙ্গির ছকের প্রয়োগ
লেখনভঙ্গি বা সুখপাঠ্য লেখার বৈশিষ্ট্য কথা শুনে কি আঁতকে উঠছেন? এত কিছু মেনে লেখা সম্ভব হবে কি না সেটা ভাবছেন? আসলে ব্যাপারগুলো কিন্তু মোটেও কঠিন কিছু নয়। আমাদের বেশিরভাগ লেখাই আমরা আমাদের অবচেতন মনে কম বেশি এই ছকের মধ্যেই লিখি। এই যেমন ধরুন একটু আগে গাড়িতে বসে ফুল বিক্রেতার সাথে দেখা হয়ে যাবার ছোট্ট একটা গল্প আমরা শুনছিলাম, এটাকেই একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
আপনি গাড়িতে করে যাচ্ছেন। গাড়িটা চলতে চলতে একসময় সিগন্যালে থেমে গেল।
এই অংশটুকুকে আমরা অনায়াসে ভূমিকা বলতে পারি। কোনো একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে এবং সেটার প্রেক্ষাপটটাও জানা যাচ্ছে।
গাড়ির জানালা দিয়ে ছোট্ট একটা হাত ঢুকে গেল ভেতরে। হাতে ধরা টকটকে লাল, তাজা চমৎকার ক'টা গোলাপ ফুল। পাঁপড়ির ওপর দুয়েকটা পানির ফোঁটায় রোদের সোনালি ঝিলিক। অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য।
এখানে ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা ঘটনার ভেতর প্রবেশ করেছি।
হঠাৎ ফুলগুলো ধরে রাখা মেয়েটার দিকে আপনার নজর যেতে আপনি একটা ধাক্কামতো খেলেন। মলিন চেহারার একটা মেয়ে।
তারচেয়ে মলিন তার পোশাক। খড়ের মতো চুলগুলোয় শেষ কবে তেলপানি পড়েছিল তা কে জানে! আসামান্য সৌন্দর্যের সওদাগর হচ্ছে অতিসামান্য, অতিমলিন একটি শিশু। মেয়েটাকে দেখে আপনার খুব মায়া লাগছে। আপনি ব্যাগ হাতড়ে মোটামুটি বড় একটা নোট মেয়েটাতে দিয়ে বললেন, পুরোটাই রাখ, ফেরত দিতে হবে না।
এই পর্যায়ে এসে আপনি কিছু একটা লক্ষ্য করেছেন। কিছু একটা ভাবছেন। এটাকে অনায়াসে পর্যবেক্ষণ বলা যায়। সেই সাথে ঘটনাও সামনে এগিয়ে চলেছে। নতুন কিছু উপলব্ধি আসি আসি করছে।
আনন্দে মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেলল। সাদা দাঁতের ঝলকানিতে আপনি আবারও বিস্মিত হয়ে পড়লেন। অতি অদ্ভুত সুন্দর সেই হাসি। মুহূর্তে জন্য আপনি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন, কোনটা বেশি সুন্দর? আপনার হাতের গোলাপগুলো, নাকি বাইরের মলিন আবরণের পেছনের ওই নির্মল হাসিটুকু?!
এইখানে এসে উপলব্ধি পূর্ণাঙ্গতা পাচ্ছে। সেইসাথে আপনি পাঠককেও কিন্তু পরোক্ষভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন। আপনার সাথে সাথে পাঠকও ভাবছেন, 'তাই তো'!
সিগন্যাল বাতি বদলে সবুজ হয়ে গেছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আর আপনি তাতে বিহ্বল হয়ে বসে আছেন।
এখানে এসে আপনি আপনার 'নটে গাছটি মুড়িয়ে' দিচ্ছেন, গল্পটি ফুরিয়ে যাচ্ছে। উপসংহারের সাথে মিলটা পাচ্ছেন কি?
শেষকথা
এখানে আমরা যা আলোচনা করলাম একেবারেই প্রাথমিক কিছু ধারণা দেয়ার প্রয়াস মাত্র। সৃজনশীলতার কোন সীমাও নেই, পরিসীমাও নেই। এখানের আলোচনা সবকিছুই যে লাইন বাই লাইন মেনে চলতে হবে এমন নয়। মূল জিনিসগুলো ঠিক রেখে আপনি আপনার সৃজনশীলতা কাজে লাগাতে পারেন। ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলে লিখে নিজেই পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে পারেন। আর পরীক্ষা চালাবার জন্য কোরামের চাইতে ভাল প্ল্যাটফর্ম আর কীইবা হতে পারে?
সবার জন্য শুভকামনা।