শত কথা

নিবন্ধ

ধেয়ে আসছে খাদ্য সংকটের ভয়াল হুমকি

ই স লা ম ত রি ক
 ক্রমাগত বেড়েই চলছে আমাদের জনসংখ্যা। সঙ্গে বাড়ছে আমাদের খাদ্য চাহিদাও। কিন্তু বাড়ছে না আমাদের স্বপ্নীল ভূখন্ডের পরিধি। দিন দিন এঁটে আসছে আমাদের আবাদযোগ্য জমি। বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের কৃষি নির্ভর একটি দেশ। এখনো এদেশের ৭০ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের অভিভাবকদের মাথা ব্যাথা থাকলেও তার গুরুত্ব হারাচ্ছে বার বার। আজকে দেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের অভিভাবরা যে ভাবে স্বতষ্ফূর্ত মত প্রকাশ করছেন, কৃষি জমির সংকট নিরসনে যদি সে ভাবে মত প্রকাশ করত, তাহলে হয়তো এতো দিনে আমাদের একটি উপায় বের হয়ে যেত। তবে সরকার কৃষি খাতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহন করলেও তা কাজের কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
বিশ্ব ব্যাংকের মতে,
বাংলাদেশের মোট আবাদ যোগ্য জমির পরিমান হল ২ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার একর।
অার মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমান মাত্র ০.২৮ একর।
বাংলাদেশে প্রতি কৃষকের আবাদি জমির পরিমান মাত্র ১.৫০ একর প্রায়। বাংলাদেশ
পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং কৃষি বিভাগের হিসাব মতে প্রতি বছর দেশের কৃষি জমির পরিমান কমছে ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর, অর্থাৎ প্রতি বছর শতকরা এক ভাগ হিসাবে আবাদ যোগ্য জমির পরিমান কমে যাচ্ছে।
উপরোক্ত পরিসংখ্যান মতে আমরা সহজেই বুঝতে পারছি যে, আমাদের কৃষক সমাজ কতো প্রতিকুলতার মাঝেও খাদ্য উৎপাদনের জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের নিশ্চিত খাদ্য সংকটে পড়তে হবে, যদি এক্ষনি এ বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চালানো না হয়।
দিন দিন আবাদি জমি কমে যাওয়ার অন্যতম কারনগুলো হলো- (ক) অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন (খ) নদী ভাঙ্গন (গ) জমির লবনাক্ততা বেড়ে যাওয়া। এবার আমরা একটু চোখ বুলিয়ে নেয় উল্লেখিত বিষয়গুলোর উপর।
(ক) অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন:
দ্রুত নগরায়ন, শিল্প ও আবাসন গড়ে ওঠায় কৃষি জমির পরিমাণ দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি জমি ব্যবহৃত হচ্ছে নগরায়নে। শিল্পকারখানা ও নানারকম স্থাপনায় গত এক-দেড় দশকে এই চিত্র ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণায় এর নেতিবাচক দিক উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদরা কৃষি জমিতে গড়ে ওঠা নগরায়ন, শিল্পকারখানা গড়ে ওঠাকে জাতীয় অর্থনীতির জন্য হুমকি বলে মনে করছেন। কৃষিবিদরাও একই অভিমত ব্যক্ত করে এর সঙ্গে শঙ্কার দিকটি তুলে ধরে বলছেন, দেশের কৃষি জমির এই অপব্যবহার কঠোরভাবে রোধ করতে না পারলে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে শুধু ধসই নামবে না, লাখ লাখ কৃষিজীবী বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে।
অপরদিকে,দেশে চলমান অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের লাগাম টানা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে বলে আবারো সতর্ক করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
এ অবস্থায় বিপর্যয় ঠেকাতে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়ার পাশাপাশি পরিবেশ আইনের কঠোর বাস্তবায়নের দাবি জানান তারা।
কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্ট-এর ২০তম সাধারণ সভা ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-
অপরিকল্পিত নগরায়ন রোধ ও পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে স্থপতিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন । তিনি বলেন, শুধু ভবনের নকশা ও নির্মাণ কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে পরিবেশবান্ধব শহর গড়ার কাজে স্থপতিদের মনোযোগ দিতে হবে।
অন্যদিকে,হাইকোর্ট জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের কৃষি জমি সংরক্ষণে সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন। হাইকোর্টের এ রুল সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ তাৎপর্যের দাবিদার বলে মনে করে বিশেষজ্ঞগণ।
(খ) নদী ভাঙ্গন:
ভয়ংকর এক দূর্যোগের নাম নদী ভাঙ্গন। এই নদী ভাঙ্গনের জন্য বেড়ে যায় আমাদের দেশের বেকারত্বের হার ও দারিদ্রতা। বাড়ি-ঘর, জমি-জমা,আত্মীয়- স্বজন, গৃহপালিত পশু-পাখি হারিয়ে একজন মানুষ নিঃস্ব অবস্থায় দাঁড়ায় পথের মাঝে। তারা হারিয়ে ফেলে জীবনের খেই।
দিন দিন আমাদের নদী ভাঙ্গনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদী ভাঙ্গন একদিকে যেমন একটি মানুষকে নিঃস্ব করে পথে বসাচ্ছে, অন্যদিকে আমাদের কৃষি জমি কমিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
(গ) লবনাক্ততা:
ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশ। এই ছোট্ট আয়তনের মধ্যে ২০% = ২৯০০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে উপকুল বিস্তৃত। এর মধ্যে ৩০% জমি চাষযোগ্য ১৭% মাছচাষ সহ অন্যান্য কাজে এবং ৫৩% জমি পতিত শুধুমাত্র লবনাক্ততার জন্য। কিন্তু আবহাওয়ার প্রতিকুলতার জন্য চাষযোগ্য ৩০% জমিও তেমন ব্যাবহার হয় না। জমিগুলো চাষযোগ্য হলেও উল্লেখিত জমির লবনাক্ততা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে চাষযোগ্য জমির পরিমান।
বাংলাদেশ এ মুহূর্তে মোটামুটিভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষি জমি হ্রাসের পরিণতিতে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেলে এ ক্ষেত্রে সংকট দেখা দেবে। দেশের জনসংখ্যা যেখানে বেড়েই চলেছে সেখানে কৃষি জমি হ্রাস পেলে খাদ্য চাহিদা পূরণে সংকট হওয়ারই কথা। স্বাধীনতার পর গত চার দশকে কৃষি জমির পরিমাণ বিপুলভাবে হ্রাস পেলেও উন্নত চাষাবাদের কারণে এ সংকটের উদ্ভব হয়নি। তবে কৃষি জমি কমতে থাকলে উন্নত প্রযুক্তির চাষাবাদ করেও এক পর্যায়ে শেষ রক্ষার উপায় থাকবে না। দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও অশনি সংকেত হয়ে দেখা দেবে। খাদ্য আমদানিতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হলে তা দেশের অর্থনীতিতে বিসংবাদ বলে বিবেচিত হবে। এ সমস্যার মোকাবিলায় সুপরিকল্পিত আবাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষি জমির অপচয় রোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে। আবাসিক চাহিদা অবশ্যই একটি মৌলিক চাহিদা এবং এটি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তবে কৃষি জমির ওপর চাপ কমিয়ে কীভাবে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
সারা দুনিয়াতেই সব রাষ্ট্রের ভূমি ব্যবহার বিধি রয়েছে যা আমাদের নেই। এই ব্যবহার বিধিটিও চূড়ান্ত করা প্রয়োজন এবং এক্ষেত্রে পল্লী এলাকার ভবিষ্যৎ গৃহায়ণ চাহিদা পূরণের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে একটি বাস্তব, কার্যকর ও ফলপ্রসূ গৃহায়ণ নীতিমালা তৈরি করাও জরুরি বলে আমি মনে করি।
ইসলাম তরিক
সান্তাহার,বগুড়া।
 
Top