ইসলামে কাব্য চর্চাঃ
সংগ্রহেঃ নাছির বিন ইব্রাহীম
------------------------------
মহিলা কবি খানসার প্রতি সমর্থন :
প্রখ্যাত মুখাদরাম মহিলা কবি খানসা শোক-গাঁথা রচনায় শীর্ষস্থানীয়া ছিলেন। আপন গোত্রীয় লোকদের সাথে ইসলাম গ্রহণ করার জন্যে রসুলুল্লাহর (সা.) দরবারে আসেন। গোত্রীয় লোকগণ গর্বভরে হযরতের নিকটে খানসার রচিত কবিতা ও কাব্য-প্রতিভার সুখ্যাতি করেন। এতদশ্রবণে খানসাকে হযরত (সা.) তার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করার নির্দেশ দেন। আদিষ্ট হয়ে খানসা আবৃত্তি শুরু করেন। তিনি একটু বিরত হয়ে রসুল ‘ওয়া খানসা’ (খুনাস) বলে আরো আবৃত্তি করার জন্যে উৎসাহিত করতেন[31]। এ ভাবে তিনি কবি খানসার প্রতি সমর্থন দেন।
আদর্শ-কবিকে পুরস্কৃত করেছেন[32] :
কা‘ব ইবন জুহায়র (রা.) ইসলাম কবুল করতে এসে মদীনার মসজিদে হযরত মুহাম্মদের (সা.) প্রশংসায় এক সুদীর্ঘ কাস্বীদা পাঠ করেন। যার প্রারম্ভিক স্তোত্রটি ছিলো :
“বানাত সু‘য়াদু ফা কালবিল ইয়াউমা মত্বুলু + মুতায়্যামুন ইসরাহা লম্ ইয়ুফদা মক্বুলু।”
অর্থাৎ : ‘সুয়াদ’ চলে গেছে, বিরহ-ব্যথায় আমার অন্তর আজ বিদীর্ণ, আমি শৃঙ্খলাবদ্ধ, প্রেমের বন্দী, আমার মুক্তিপণ দেওয়া হয়নি। কা’ব যখন নিম্ন চরণটি আবৃত্তি করলেন-
“ইন্নার রাসুলা লনূরুন ইয়ুসতাদাও বিহী* মুহান্নাদুন মিন সুয়ু-ফিল্লাহি মসলুলু।”
অর্থাৎ : নিশ্চয় রসুল (সা.) আলোক, তাঁর দ্বারা আঁধার দুর হয়। তিনি আল্লাহর তরবারি সমূহ থেকে একটি কোষ-মুক্ত ধারালো অশি। উক্ত কাস্বীদা শ্রবণ করে রসুলুল্লাহ (সা.) আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে স্বীয় চাদর খানা পরবর্তী সময়ে ক‘অবের বংশধরদের নিকট থেকে আমীর মু‘আভীয়া চল্লিশ হাজার দিরহাম দিয়ে খরিদ করে নেন। উমাইয়া খলীফা ও আব্বাসীয় খলীফা এবং উসমানীয় খিলাফত পর্যন্ত এটা হস্তান্তরিত হতে থাকে ও মুসলিম খলীফাগণ রাজ্যাভিষেকের সময় বরকত লাভের আশায় চাদরটি পরিধান করতেন[33]।
হযরত স্বয়ং কবিতাবৃত্তি করেছেন :
এ কথা সত্য যে, মুহাম্মদ (সা.) অভ্যাস কবি ছিলেন না। তবুও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, তিনি শুধু মাত্র আদর্শ কবি ও কবিতাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহ প্রদান করেননি; বরং মাঝে মাঝে নিজেও কবিতাবৃত্তি করেছেন। যেমন :
(ক) হযরত বররা (রা.) বলেন, খন্দকের দিন হযরত রসুলুল্লাহ (সা.) মাটি সরাচ্ছিলেন-এতে তাঁর পবিত্র দেহ ধূলি-ধূসর হয়ে যায়, তখন তিনি আবৃত্তি করছিলেন[34]–
“ওয়াল্লাহি লও লাল্লাহু মাহ্ তাদায়না* ওলা তাসাদ্দাকনা ওলা সাল্লায়না,
ফানঝিলান সাকিনাতান্ ‘আলায়না* ও চাব্বিতিল আকদামা ইন লাকায়না,
ইন্নাল ঊলা কদ্ কাউ ‘আলায়না* ইজা আরাদূ ফিতনাতান আবায়না।”
অর্থাৎ : আল্লাহ শপথ, যদি আল্লাহ না থাকতেন, আমরা না সৎ পথ প্রাপ্ত হতাম, না দান-ছদকা করতাম, না উপাসনা-অর্চণা করতাম। হে আল্লাহ আমাদের মনে শান্তি দাও, জিহাদের ময়দানে আমাদেরকে দৃঢ় রাখো, পূর্ব সুরীগণ আমাদের সাথে বাড়া-বাড়ি করছে। তারা যখন বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চাইলে আমরা তাদেরকে এড়িয়ে চললাম[35]।
(খ) হযরত আনাস (রা.) বলেন, মুহাযির ও আনসারগণ খন্দক খুঁড়ছিলেন ও মাটি সরাচ্ছিলেন, আর আবৃত্তি করছিলেন –
“নাহনুল্ লাজি-না বায়া‘উ মুহাম্মাদান* ‘আলাল যিহাদি মা বাকায়্না আবদান।”
অনুবাদ : আমরা সেই সে দল যারা এ মর্মে মুহাম্মদের (সা.) হস্তে শপথ বাক্য উচ্চারণ করেছি যে, আ-মৃত্যু জিহাদ করে যাবো। এতদ শ্রবণে হযরত (সা.) বলেছেন[36]–
“আল্লাহুম্মা লা ‘আইশা ইল্লা ‘আয়শুল আখিরাহ* ফাগ ফিরিল আনসারা ওল্ মুহাজিরা।”
অর্থাৎ : হে আল্লাহ। পরকালীন জীবনই প্রকৃত জীবন, আনসার ও মুহাজিরদেরকে মার্জনা করো।
(গ) হযরত আবু হুরায়রা বলেন, রসুলুল্লাহ বলেছেন, কবির সে উক্তিই সর্বাধিক সত্য-যা লবীদ বলেছেন[37]–
“আলা কুল্লু শাইয়িন মা খালাল্লাহি বাতিলুন* ও কুল্লু ন‘য়ীমিন লা মহালাতা ঝায়িলুন।”
অর্থাৎ : আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই নিরর্থক, আর সব নি‘য়ামতই নিশ্চয় অপসৃত হবে।
(ঘ) হযরত মুহাম্মদ (সা.) হোনায়নের ময়দানে আবু সুফিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন[38]–
“আনান্নাবী লা কাজিব* আনা ইবনু ‘আব্দুল মুত্তালিব।”
অর্থাৎ : আমি নবী, মিথ্যাবাদী নই, আমি আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর।
(ঙ) আমর ইবনু শুরাইদ স্বীয় জনক আশ্শুরাইদ থেকে উদ্ধৃত করেন, আমি একদিন একই সওয়ারীতে রসুলের (সা.) পশ্চাতে উপবিষ্ট ছিলাম। রসুল (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “উমাইয়া ইবনু আবী সসিলতের কবিতা কি তোমার জানা আছে?” আমি বললাম, হ্যাঁ, তা জানা আছে। হযরত আমাকে তা আবৃত্তি করার আদেশ করলেন, আমি একটি পংক্তি আবৃত্তি করলাম। রসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে আরো আওড়াতে বললেন, আমি আরো একটি পংক্তি আবৃত্তি করলাম। রসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে আরো আওড়াতে বললেন, আমি এভাবে উক্ত দিবস হযরতকে (সা.) উমাইয়া বিরচিত একশটি কবিতা পংক্তি আবৃত্তি করে শোনালাম[39]। অন্যত্র উমাইয়া সম্মন্দে রসুল মন্তব্য করে বলেছেন, “তার ভাষা ঈমানদার হয়েছে আর তার হৃদয় কাফের রয়েছে[40]।”
হযরত কবিতাকে জিহাদের হাতিয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
‘ইস্তিয়াব’ গ্রন্থে ইবন-আবদুল বার উল্লেখ করেছেন, রসুলুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলাম, “কবিতা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?” প্রত্যুত্তরে রসুল (সা.) বললেন, “মু‘মেন তো স্বীয় তরবারি ও জিহবার সাহায্যে জিহাদ করে[41]।”
হযরতের (সা.) প্রাণ-প্রিয় সাহাবাগণ কবিতার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ঃ-
রসুলের (সা.) প্রাণ-প্রিয় সাহাবাগণও কবিতার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তাঁদের কেহ কেহ কবিতা রচনা করেছেন। কে.এ.ফারিক আল-শা‘বীর (মৃত্যু-১০৩/৭২১) সূত্রে উল্লেখ করেছেন, “প্রথম চারজন খলীফার সকলই কবি ছিলেন[42]।”
ইবন-ইসহাক হযরত আবু বকরের (রা.) রচিত একটি কবিতার উল্লেখ করেছেন। কবিতাটি ‘উবায়দা-ইবনু-হারিসের’ গযওহকে উপলক্ষ করে রচিত। এর কিছু অংশ নিম্নরূপ[43]–
“রসুলুন আতাহুম ফাতাকজিবু *‘আলায়হি ও কালু লসতা ফি-না বি মাকিছি,
ইজা মা দা‘আউনাহুম ইলাল্ হাককি আদবারো* ওয়া হারাউ হারিরাল মুজহিরাতিল লওয়াহিবি।”
অর্থাৎ ঃ তাদের নিকট সত্য রসুল (সা.) এসেছেন, কিন্তু তারা তাঁকে অমান্য করেছে ও বলেছে, তুমি আমাদের এথায় থাকতে পারো না। যখন আমরা তাদেরকে সত্যের প্রতি আহ্বান করেছি, তোমরা কুকুরের মতো পশ্চাৎপসারণ করেছ। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক এ কবিতা আবু বকরের (রা.) বলে মানেন না।
কে.এ.ফারিক হযরত আবু বকর (রা.)-এর আর একটি কবিতার কথা উল্লেখ করেছেন। উক্ত কবিতায় হযরত আবু বকর (রা.) ‘আবু জনদল’ নামক জনৈক সেনাধ্যক্ষকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন[44]–
“নফসসুন ‘ইসামুন সাউয়্যেদাত্ ই‘সামান ও ‘আউয়্যেদাতহুল কুররু ওল ইকদামা।”
অর্থাৎ : ইসলামের বীর পুরুষগণ তাদেরকে জন্ম দিয়েছেন, আর বারংবার আক্রমণ ও অগ্রগামীতা তাদের বৈশিষ্ট্য।
হযরত আ‘য়িশা (রা.) থেকে হযরত আবু বকর (রা.)-এর একটি কবিতা পংক্তি বর্ণিত আছে[45]–
“কুল্লুমরিয়িন মুসবিহুন ফি আহলিহী ওয়াল মউতু আদনা মিন্ শিরাকিনি আলিহী।”
অর্থাৎ : প্রত্যেক ব্যক্তি স্বীয় পরিবার-পরিজনের মাঝে এমতাবস্থায় প্রত্যুষে গাত্রোত্থান করে যে, মৃত্যু তার জুতুর (পাদুকার) ফিতা (পাদুকার উপরিভাগে চামড়ার লম্বা টুকরা) অপেক্ষাও অতি নিকটবর্তী প্রতীয়মান হয়।
হযরত ওমর (রা.) কবিতা সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখতেন, কিন্তু তিনি কোন কবিতা রচনা করেছেন-এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাঁর সময়কার প্রশাসকদের তিনি ফরমানের মাধ্যমে কবি গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করতেন। বসরার গভর্ণর আবু মুসা-আল-আশ‘আরীকে এক লিখিত ফরমানে তিনি জানান[46]–
“মুর্ মান্ কাবলাকা ইয়াতা‘ল্লাম্শশিরা ফাইন্নাহু ইয়াদুল্লু ‘আলা মা-‘আলীয়্যিল্ আখলাকি ও সওয়াবিররা-ই ও মা’রিফাতিল আনসসাবি।”
অর্থাৎ : তোমার সেখানকার লোকদেরকে কবিতা শেখার জন্যে নির্দেশ দাও, কবিতা, উন্নত চরিত্র, সঠিক সিদ্ধান্ত ও আরবদের বংশ পরিচয়ের সঠিক ধারণা প্রদান করে। অন্যত্র আছে, তিনি প্রাদেশিক শাসন-কর্তাদের নিকট এ মর্মেও ফরমান পাঠাবেন, “তোমাদের সন্তান-সন্ততীদেরকে কবির উত্তম বর্ণনা ও প্রচলিত আরবী প্রবাদ-বাক্য বর্ণনা করে শোনাও[47]।” হযরত ওমরের কাব্য-নির্বাচন ক্ষমতা অত্যন্ত প্রখর ছিলো। একবার গাতকান গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল হযরত ওমরের সাক্ষাৎ লাভ করার জন্যে আসেন। বলা বাহুল্য, উক্ত গোত্র মু‘আল্লাকা যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ও কাব্য-নির্বাচক ‘আল-নাবিঘার’ গোত্র ছিলো। হযরত ওমর (রা.) উক্ত প্রতিনিধিদলকে এ মর্মে প্রশ্ন করলেন যে, “তোমাদের গোত্রের শ্রেষ্ঠ কবি কে?” প্রতিনিধি দলটি প্রত্যুত্তরে জানালেন, “হে বিশ্বাসীগণের নেতা, আপনি এ বিষয়ে আমাদের অপেক্ষা উত্তমভাবে নির্বাচন করতে পারেন[48]।” এ আলোচনার দ্বারা বুঝা যায় হযরত ওমর (রা.) কত বিশ্বস্ত ও কাব্য নির্বাচক ছিলেন।
খলিফা ওসমান গণি (রা.) কিছু কবিতার রচয়িতা বলে জানা যায়, বিদ্রোহীদের দ্বারা গৃহ-বন্দী অবস্থায় তিনি হযরত আলীর নিকট লিখিত এক পত্রের শেষ ভাগে লিখেছেন[49]–
“ফা-ইন্ কুনতু মা‘কূলান ফাকুন আনতা আ’কিলী* ও ইল্লা ফাদ্রিকনী ওলাম্মা উমাঝ্যিকু।”
অর্থাৎ : আমি যদি খাদ্য-বস্তু (হত্যার উপযুক্ত) হই, হবে তুমিই আমাকে ভক্ষণ (হত্যা) করো। আর যদি এরূপ না হই; তবে, আমি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হবার পূর্বে আমাকে রক্ষার জন্যে এগিয়ে আসো।
হযরত আলী ছিলেন আরবী সাহিত্যের একজন বড় ব্যক্তিত্ব। আল-বরুছী তাঁকে খুলাফায়ে রাশেদীনদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। নাহজুল বালাগায় তাঁর অসংখ্য কবিতা পাওয়া যায়। হাদীস, লুঘাত ও আরবী সাহিত্যের কিতাবে তাঁর অসংখ্য কবিতা রয়েছে। নিম্নে তাঁর রচিত রাজছন্দের একটি কবিতাংশ উল্লেখ করা গেল :
“লা ইয়াসতাওয়ী মান্ ইয়া‘মুরুল মাসাজিদা * ও ইয়াদ্ ‘আবু ফি-হা কায়মান ও কায়িদান”
ওমান ইয়ুরা ‘আনিল গু’বারি হায়িদান।”
কে.এ.ফারিক, তদীয় হিস্ট্রী অব এরাবিক লিটারেচার গ্রন্থে কবিতাটি উল্লেখ করেছেন নিম্নরূপে :
“লা ইয়াস্তাওয়ী মান্ ইয়া‘মুরুল মাসাজিদা * ও ইয়াদ্ ‘আবু ফিহা কায়িমান ও কায়িদান,ওমান ইয়ুরা ‘আনিততুরাবি হায়িদান।”
অর্থাৎ : তিনি গোবারি-এর স্থলে ‘আনিততুরাবি উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে উভয় শব্দের ভাবার্থ এক।
অনুবাদ : যিনি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং এ জন্যে সবাবস্থায় সাধনা করেন, অথচ তিনি সে ব্যক্তির সমকক্ষ নহেন ; যিনি বালির স্তুপকে পরিহার করে চলেন বলে পরিদৃষ্ট হন[50]।
আলী-তনয় হযরত হাসানও (রা.) কবিতা রচনা করতেন। একবার তিনি দাড়িতে কলপ লাগিয়ে বাইরে আসেন। উপস্থিত লোকেরা তাঁর দিকে দেখতে থাকলে তিনি বললেন[51]–
“নাসুদু আ‘লাহা ও তা’বা উসুলুহা * ফালায়তাল্লাজী ইয়াসুদু মিনহা হুয়াল আসলু।”
অর্থাৎ : আমরা চুলের উপরাংশে কলপ দেই, কিন্তু চুলের মূল সে কলপ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। আহা, যদি চুলের মূলও কালো হতো।
কা’ব ইবনু মালিক (রা.) ‘আমের‘কে উদ্দেশ্য করে বলেন[52]–
“মা‘আজাল্লাহি মিন্ ‘আমালিন্ খাবিছিন্ * কাসা‘য়্যিকা ফিল ‘আশিরতি ‘আবদ ‘আমর
ফা আম্মা কুলতুলি শরফুন ও নহলুন * ফা কদ্ মা বি’তু ঈমানান বি কুফ্রিন।”
অর্থাৎ : তুমি যেমন ‘আবদু’ আমর গোত্রের দুর্নাম করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে, তোমায় এহেন নিকৃষ্ট কাজ থেকে আমি খোদার নিকট আশ্রয় চাই। আমি তো বলি যে, আমার জন্যে সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত এবং আমি কুফুরীর বিনিময়ে সম্মান বিক্রয় করিনি।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন জজুরাযর আল-আসাদী পবিত্র কুরআনের আয়াত- “ইন্না শাজারাতাঝ্ ঝাক্কুম তা‘আমুল আছিমি কাল মুহলি ইয়াগলি ফিল বুতুন” এ উক্তি “আল মুহলি” শব্দের ব্যাখ্যায় রচনা করে বলেন[53]–
“ফামান ‘আশা মিনহুম ‘আশা ‘আবদান ও ইন্ ইয়ামুত * ফাফিন্নারী ইয়ুসকা মুহলুহা ও সাদীদুহা।”
অর্থাৎ : তাদের (বিধর্মী) জীবিতগণ দাস-জীবন অতিবাহিত করছে, আর মৃতগণ জাহান্নামের মাঝে পূঁজ ও গলিত বস্তু ভক্ষণ করছে।
ইসলাম দীক্ষিত হবার পর হযরত আব্বাস ইবন মিরদাস বলেছেন[54]–
“ফা-ইন্ তাকু কদ্ আমমারতা ফিল্ কউমি খালিদান * ও কদ্দামতাহু ফাইন্নাহু কদ্ মুকাদ্দামান,
বিজুনদিন্ হাদাহুল্লাহু আনতা আমীরুহু * ইয়াসিবু বিহিল হক্কা মান কানা আজলামা।”
অর্থাৎ : (হে আল্লাহর নবী) খালিদকে (রা.) যদি আপনি গোত্রের নেতা মনোনীত করেন এবং তাঁকে প্রাধান্য দেন, (তাহলে) নিশ্চয় সে অগ্রগামী। সে এমন একটি সেনাদল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, যে দলকে মহান আল্লাহ সঠিক পথ দান করেছেন, আর আপনি হচ্ছেন উক্ত দলের আমীর।
হযরত আউন-ইবন-আইয়ুবুল ‘আনসারী, আকাবার দ্বিতীয় শপথের দিন বারা-ইবন-মারূরের প্রশংসায় বলেছেন[55]–
“ও মিন্নাল মুসাল্লিও আওয়্যালুননাসি মুকবিলান * ‘আলা কা‘বাতির রাহমানি বাইনাল মাশা’য়িরি।”
অর্থাৎ : সর্ব প্রথম নামাযী আমাদের লোক করুণাময়ের কা‘বামুখী হয়ে নামায আদায় করেছেন- যে কা’বা মহান আল্লাহর নিদর্শনসমূহের একটি।
হোনায়নে মুসলমানদের বিজয়ের পর জনৈকা মুসলিম রমণী বলেন[56]–
“কদ্ গালাবাত্ খায়লুল্লাহি খয়্ লুললাতি * ওয়াল্লাহু আহাক্কু বিসছিবাতি।”
অর্থাৎ : আল্লাহর অশ্বারোহী (সেনা) দল লাতের (শিরকের) অশ্বারোহী দলকে পরাভূত করেছে, আর আল্লাহই হলেন অনাদী ও অনন্ত। হযরত বুযায়র (রা.) স্বীয় ভ্রাতা ক’বকে লিখেন :
“মান মুবলিগ ক’বান ফহাল লাকা ফিললাতি * তালুমু ‘আলাইয়্যা বাতিলান ও হিয়া আহঝাম,
ইলাল্লাহি লাল্‘ওজ্জা ও লাললাতি ওহদাহু * ফাতনজু ইজা কানান নাজাউ ও সল্লিমু।”
অর্থাৎ : ক’বকে এ মর্মে এ বাণী কি কেউ পৌঁছে দেবে যে, তুমি আমাকে এমন এক বিজয়ের অসারতার বিষয়ে ধিক্কার দিচ্ছো- অথচ সে বস্তুই সঠিক? এক, অদ্বিতীয় আল্লাহর পথে ফিরে আসো, লাত ও ওজ্জার পথে নয়। তা হলে, যখন মুক্তি আসবে, মুক্তি ও নিরাপত্তা পাবে।
লবীদ (রা.) : মু‘আল্লাকা যুগের মধ্যমণি কবি লাবীদ সম্মন্ধে আর.এ.নিকলসন বলেন, “ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি এ বলে কবিতা শপথ পূর্বক পরিত্যাগ করেন যে, মহান আল্লাহ আমাকে (কবিতার পরিবর্তে) কুরআন দান করেছেন”[57]। হযরত ওমর যখন লবীদকে (রা.) লিখে পাঠালেন, “তোমার কবিতা আমাকে আবৃত্তি করে শোনাও।” কবি লবীদ (রা.) সুরা বাকারা আবৃত্তি করে শোনালেন আর বললেন, “আল্লাহ যখন আমাকে বাকারা ও আল-ইমরান সুরাদ্বয় লিখবার তওফিক দিয়েছেন, আমি আর কবিতা বলবোনা।” বলা বাহুল্য, ওমর (রা.) এতে সন্তুষ্ট হয়ে লবীদের ভাতা পাঁচশ দিরহামে উন্নীত করেন[58]। জুরজী যায়দান তদীয় তারীখু-আদাবিল-লুগাল-আরাবীয়া গ্রন্থে আহমদ হাসান যয়্যাত তদীয় তারীখু-আদাবিল-আরাবী গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, লবীদ ইসলাম গ্রহণ করার পর নিম্ন পংক্তিটি রচনা করেছেন[59]।-
“আল্হাম্দু লিল্লাহি ইজলাম ইয়া’তিনী আজালী * হাত্যা লাবিসতু মিনাল ইসলামি সিরবালা।”
অর্থাৎ ঃ মহান আল্লাহর প্রশংসা, ইসলামে দীক্ষিত হবার পূর্বে তিনি আমাকে মরণ দান করেন নি।
এ কথা সত্য যে, হযরত লবীদ ইসলামে দীক্ষিত হবার পর তাঁর ইসলাম পূর্ব যুগের মতো কাব্যকে জীবন-লক্ষ্য হিসেবে, উপজীবিকার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন নি। তবে, প্রয়োজনে দু’একটি পংক্তি রচনা করেছেন। পবিত্র কুরআনের আলংকারিক সৌন্দর্য ও প্রাঞ্জলতায় অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনি কুরআনের শিক্ষায় সর্বাধিক মনোনিবেশ করেছিলেন। অথচ জুরজী যায়দান ও যয়্যাতের বর্ণনা মতে এ কথা বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি মুসলমান হওয়ার পর মাত্র ও পংক্তিটুকুই রচনা করেছিলেন।
হযরত আবু দুজানা (আসল নাম সিমাক ইবন খারাশা-আল-আনসারী-আলসা আদী) ওহুদের ময়দান রসুল (সা.) তাঁকে স্বীয় তরবারী প্রদান করলে তিনি বলেছেন[60]–
“আনাললাজি ‘আহাদানী খলিলী * ও নাহনু বিসসফহি লদাননাখীলি;
আন লা আকুমাদদাহরা ফিল্ কুয়ূলি * আদ’বির বি সাইফিল্লাহি ওর্ রসুলি।”
অর্থাৎ : আমরা খেজুর বৃক্ষের নীচে সমতল ভূমিতে অবস্থানরত অবস্থায় আমার বন্ধুর সাথে এ মর্মে শপথ করলাম যে, আমি কখনো পশ্চাৎসারিতে দাঁড়াবোনা, আল্লাহ ও তদীয় রসূলের অশি দ্বারাই আঘাত হানতে থাকবো।
ইসলামে দীক্ষিত হবার পর হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবনুজজিব আরী (রা.) রসুলে করীমকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন[61]–
“ইয়া রসুলাল মালীকি ইন্না লিসানী * রাতিকুন মা ফানাকাত ইজ্ আনা বুরু,
আনা বারিয়ু শশায়তানি ফি সুননিল্ * গাইয়্যি ওমান্ মালা ময়লাতান মসবুরু
আ-মানাল্লাহমু ওয়াল ইজামু লিরাব্বী * ছুম্মা কালরীশশহীদু আনতান নজীরু,
ইন্নানী আনকা ঝাযেরুন ছুম্মা হাইয়্যান * মিন লিওয়ায়িন ও কুল্লুহুম মগবুরু।”
অর্থাৎ : হে আল্লাহর রসুল (সা.) নিশ্চয় আমার ভাষা অক্ষম, এখনো ধ্বংস হয়নি, অথচ; আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। শয়তান যখন পথ ভ্রষ্টতার প্রতিযোগিতা করে- যে এ পথে আকৃষ্ট হয় সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আমার অস্তি ও মজ্জা আমার প্রভুর ওপর ঈমান এনেছে। অতঃপর আমার অন্তর সাক্ষী দিচ্ছে যে, আপনি একজন ভয়-প্রদর্শক। আমি আপনার পথ থেকে লওয়াই গোত্রকে (আল্লাহ ও পরকালের) ভয়-প্রদর্শন করবো-অথচ, তারা সবাই অহংকারী। ইসলামে দীক্ষিত হবার পর হযরত ‘ফুজালা’ : স্ত্রীকে বলেন[62] :
“কালাত হালুম্মা ইলাল হাদীছে ফা কুলতু লা,
ইয়া‘বা ‘আলায়কিল্লাহু ওয়াল ইসলামু,
লও মা রাআয়তি মুহাম্মাদান ও কবীলাহু,
বিল্ ফতহি ইয়াওমা তুকছিরুল আসনামা।
লারাআয়তি দ্বীনাল্লাহি আদহা বাইয়্যেনান,
ওশশিরকু ইয়াগশা ওজহাহু লিআজলামি।”
অর্থাৎ : আমায় সে আহবান করে বললো, এসো আলাপ করি, আমি বললাম, না, আল্লাহ ও ইসলাম তোমাকে সংগদান অস্বীকার করেন। মক্কা বিজয়ের দিন, যেদিন মুহাম্মদ (সা.) (ও তাঁর সহচরগণ) মূর্তি সমূহকে ভাঙ্গছিলেন যদি তুমি তিনি ও তাঁর গোত্রকে দেখতে, তবে তুমি দেখতে আল্লাহর মনোনীত ধর্ম (ইসলাম) উজ্জ্বল এবং শিরকের অবয়ব অন্ধকারে আচ্ছাদিত।
নবী নন্দিনী ফাতিমাতুয যোহরা (রা.) রসুলে খোদার (সা.) ওফাতের পর মর্মিয়ামর্ধী না’ত রচনা করেন, তার অনুবাদ কবিতাকারে নিম্নরূপ[63] :
“যে কেউ সুঘ্রাণ নেয় নবীর মাযারে একবার,
লাগবেনা ভালো তার পৃথিবীর কোন ঘ্রাণ আর।
দারুণ আহত আমি, হৃদয়ে এমন অন্ধকার-
দিবসে পড়তো যদি সে আঁধার কণা পরিমাণ,
তা হলে দিবস হতো চিরতরে রাত্রির সমান।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবন রওয়াহা রচনা করেছেন অগণিত কবিতা, নিম্নে তাঁর রচিত একটি পংক্তি নমুনা স্বরূপ পেশ করা গেল :
“খালফাসসালামি আলা ইমরিইন ওদ্দা‘আতুহু * ফিননাখীলি খায়রু মুশায়্যি‘য়ুন ও খলীলু।”
অর্থাৎ : আমি এমন এক ব্যক্তির সালামের জবাব দিয়েছি, যাকে আমি খেজুর বৃক্ষের নীচে উত্তমভাবে বিদায় দিয়েছি, তিনি হলেন একজন উত্তম বন্ধু।
মহানবী (সা.) শুধুমাত্র কবিতা ভালোবাসতেন না, বরং কবিতার যত্নবান হবার জন্যে এর মর্যাদা ও তাৎপর্যের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে[64]। হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা.) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। একদা নবীর (সা.) দরবারে পূর্বদেশীয় আগন্তুক আগমন করলো, তারা নবীর (সা.) সাথে সুস্পষ্ট বাক্যালাপ করলো, রসুলুল্লাহ (স.) বললেন, “বর্ণনায় যাদুশক্তি আছে, আর কবিতায় আছে প্রকৃষ্ট জ্ঞানের কথা[65]।”
পর্যালোচনা :
আমরা সামগ্রীক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথায় উপনীত হতে পারি যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কবিতা ভালোবাসতেন, তাঁর মধ্যে কাব্য প্রীতি ছিলো। সুতরাং ইসলামে কাব্য-চর্চা স্বীকৃত।
ইসলামে কাব্য চর্চা নিষিদ্ধ হলে ইসলামের নবী (সা.) আদর্শ কবিকে মসজিদে নব্বীতে পৃথক মিম্বার তৈরী করে দিতেন না, আদর্শ কবিকে পুরস্কৃত করতেন না। যেমন তিনি হযরত কা’বকে (রা.) স্বীয় চাদর দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজে কবিতা আবৃত্তি করেছেন। যেমন তিনি খন্দকের যুদ্ধের খন্দক খোড়াকালীন সময় কবিতা আবৃত্তি করেছেন। আদর্শ কবিতা আবৃত্তি করেছেন ও আবৃত্তি করায়ে শুনেছেন। যেমন- কবি লবীদের কবিতা নিজ মুখে আবৃত্তি করেছেন। উমাইয়া ইবন আবিসসিতের প্রায় একশটি কবিতা পংক্তি আগ্রহ ভরে শুনেছেন। রসুলের প্রাণ-প্রিয় সাহাবাগণও কবিতা আবৃত্তি করেছেন। নবী প্রয়োজনে তাদেরকে কবিতা চর্চার উৎসাহ প্রদান করেছেন। তদুপরী রসুল (সা.) স্বয়ং এক বাণীর মাধ্যমে কবিতাকে জিহাদের হাতিয়ার বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর কবিতা যদি ইসলামে নিষিদ্ধ হতো, তাহলে আল্লাহর রসুল (সা.) ও তাঁর সাহাবগণ কবিতার প্রতি এমন আগ্রহ উদ্দীপনা দেখাতেন না।
সিদ্ধান্ত : উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ইসলামে কাব্য-চর্চা নিষিদ্ধ নয়। তবে ইসলামে কবিতার গুণাগুণ পরখ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কবিতার বিষয়বস্তু। বিষয়বস্তু ভাল তথা কুরআন ও হাদীস সম্মত হলে সে কবিতা ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য। আর বিষয়বস্তু মন্দ তথা কুরআন-হাদীস সম্মত না হলে সে কবিতা বর্জনযোগ্য। আল্লামা শায়খ ইসমাইল হক্বী আল বরুসী তদীয় তাফসীরু রুহুল বযান গ্রন্থে আল কাওয়াশী থেকে উদ্ধৃত করেন[66]-কবিতা বাক্যগুচ্ছ, তার ভালোটা ভালো আর মন্দটা মন্দ। আর যদি কবিতার বিষয়বস্তু নিম্নলিখিত প্রকারের হয়, তবে সে কবিতা উত্তম বলে বিবেচিত হবে। যেমন :
১। আল্লাহর একত্ববাদের বর্ণনা তথা তাওহীদ,
২। পাঠক সমাজকে সৎচরিত্র অবলম্বনের প্রতি উৎসাহ দান,
৩। জিহাদের বর্ণনা,
৪। আল্লাহর উপাসনা-বন্দেগী,
৫। দায়িত্বানুভূতি তথা ফরজিয়াৎ,
৬। শালীনতা বোধ,
৭। আত্মীয়তা তথা রক্তের বন্ধন,
৮। মহানবী ও রসুলগণ এবং
৯। সৎ কর্মশীলদের যথাযথ প্রশংসার কথা সম্বলিত বিষয়বস্তু।
ইসলামে কাব্য-নির্বাচনের দৃষ্টিভঙ্গি তো এরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, “কবিতা সু-সামঞ্জস্য কথামালা, যে কবিতা সত্যনিষ্ঠ সে কবিতাই সুন্দর আর যে কবিতায় সত্যের অপলাপ হয়েছে সে কবিতাতে মঙ্গল নেই[67]।”
ইসলাম সামগ্রীক ভাবে কাব্য-চর্চা ইসলাম নিরোৎসাহীত করে। অধিকাংশ ধর্মবেত্তার (ওলামা) মতে, কাব্য চর্চা পছন্দনীয়, তবে নিম্নলিখিত বিষয়বস্তুর উপর রচিত কাব্য ইসলামে অপছন্দনীয় ও বর্জনীয়[68] :
১। মিথ্যা ও অবাস্তব কথাবার্তা,
২। কারো অহেতুক কুৎসা,
৩। মানুষকে খোদ-বিমুখ করে ও কুরআন পাঠ থেকে বিরত রাখে-এমন বিষয়বস্তু,
৪। অহেতুক প্রশংসার কথা,
৫। নিছক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কথা,
৬। অসংলগ্ন ও অশালীন উক্তি,
৭। মিথ্যা গুণে ভূষিত করার কথা,
৮। ভৎর্সনার কথা,
৯। মিথ্যা দোষারোপ করা,
১০। মিথ্যা অহংকারপূর্ণ বাক্য,
১১। হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী উক্তি,
১২। প্রদর্শনেচ্ছামূলক উক্তি,
১৩। লোভ-লালসার প্রকাশ,
১৪। নিম্ন ও হেয় কথাবার্তা,
১৫। অপদস্তমূলক বাক্য,
১৬। অযথা বংশ গৌরব,
১৭। মিথ্যা অহংকারের কথা ও
১৮। অশ্লীল উক্তি সম্বলিত বিষয়বস্তু।
মহানবীর (সা.) নিম্ন বাণীটি উক্ত ধারণাকে আরো সুস্পষ্ট করে তোলে- “কবিতা কথার মতোই। ভাল কথা যেমন সুন্দর, মন্দ কবিতা মন্দ কথার মতোই মন্দ[69]।” তিনি আরো বলেছেন, “কবিতা তো কথার মতোই কথা বিশেষ, কথার মাঝে কোনটা উৎকৃষ্ট হয় আর কোনটা হয় নিকৃষ্ট[70]।”
শ্রেষ্ঠ কবিতা পাঠে, পাঠক কবির সুগভীর আন্তরিকতা ও বিষয় তন্ময়তায় প্রবৃদ্ধ হয়। কবিতার অপর নাম জীবন-জিজ্ঞাসা বা জীবন দীপিকা। কাব্যের বিষয়বস্তু কাব্য-সৌন্দর্যকে ও সত্যকে প্রস্ফুটিত করে তোলে। তাই ইসলাম কবিতার গুণাগুণ বিচারের মানদন্ড হিসেবে বিষয়বস্তুকে নির্ধারণ করে নিয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ভালো করা যেমন সুন্দর ভালো কবিতাও তেমন সুন্দর। রসুলুল্লাহ এ উক্তি মূলতঃ মানব-কল্যাণে একটা সম্ভাব্য ইঙ্গিতবহ। অর্থাৎ, Arts for Arts sake (শিল্পের খাতিরে শিল্পের সৃষ্টি) এ চিন্তাধারার বিলুপ্তি সাধন করে Arts for life sake (জীবনের খাতিরে শিল্প) এ চিরন্তন সত্যটাই জোরদার করে।
উপসংহার : ইসলাম ফিৎরাতের ধর্ম। কবিতা মানব মনের সুকুমার বৃত্তির উন্নতি সাধন করে। ফিৎরাতের ধর্ম ইসলাম এ ক্ষেত্রে অবশ্যই নীরব থাকতে পারে না। প্রত্যেক বস্তুর দুটি গুণ রয়েছে; ভালো আর মন্দ। ভালো গুণ কল্যাণকর, তাই আগ্রহণীয়। আর মন্দ গুণ অকল্যাণকর, তাই তা বর্জনীয়। ইসলাম ধর্মে ভালো কবিতা গ্রহণযোগ্য আর মন্দ কবিতা বর্জনযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম সার্বিকভাবে কাব্য-চর্চাকে নিরুৎসাহীত করেনি। পবিত্র কুরআনই এর সাক্ষ্য। আলোচ্য সুরা আশ্-শুআরাতেই উক্ত আছে, “আর যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে এবং আল্লাহর স্মরণে অতিমাত্রায় তৎপর রয়েছে, আর অত্যাচারিত হলে নিজেদের আত্ম-রক্ষায় সচেষ্ট হয়েছে, তাদের সম্মন্ধে এ কথা প্রযোজ্য নয়[71]।” আলোচ্য আয়াতে নিম্নলিখিত চারটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কবি ও কবিতাকে ইসলাম স্বীকৃতি দিয়েছে, যথা :
১। সে ঈমানদার হবে, অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর রসুল এবং তাঁর কিতাবসমূহকে ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে মানবে ও বিশ্বাস করবে এবং ফিরিশতা ও পরকালের প্রতি সন্দেহহীন দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করবে।
২। সে নিজের বাস্তব জীবনে শত্যাদর্শ ও সত্যভাবের অধিকারী হবে। নৈতিক চরিত্রের সীমা লংঘন করে সে বলগা হারা অশ্বে পরিণত হবে না।
৩। সাধারণ সময় ও অবস্থায় খুব বেশী পরিমাণে মহান আল্লাহর স্মরণ করবে।
৪। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে কারো কুৎসা করবে না। তবে, জালেমদের বিরুদ্ধে সত্যকে সমর্থন করার প্রয়োজন দেখা দিলে সে তার কাব্যের দ্বারা সে কাজই করবে যা একজন স্বাস্থ্য মুজাহিদ তার হাতের অশি দ্বারা জিহাদের ময়দানে সম্পাদন করে থাকে।
আল্লামা তহাভী বলেন, “ফকীহগণের মত কুৎসা বা অশ্লীলতা বিবর্জিত কবিতা বর্ণনায় কোন দোষ নেই।[72]।”
ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবের মুসলমানদের মাঝে কবিতা চর্চা একটু স্তিমিত হয়ে পড়েছিলো এ কথা সত্য- এ কারণে কেহ কেহ হয়তো একথা মনে করে থাকবেন যে, ইসলাম কাব্য-চর্চাকে নিরুৎসাহিত করছে। কিন্তু এর সঠিক ব্যাখ্যা তা নয়, বরং পবিত্র কুরআনের প্রাঞ্জল-ভাষা, উৎকৃষ্ট বর্ণনা-কৌশল, চমৎকার উপমা-উৎপ্রেক্ষা, রূপক-ব্যবহার ও অলংকারময়তার সৌন্দর্যে আরবদের মন অভিভূত হয়ে পড়েছিলো। তাই তারা অন্য কিছুতে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পায়নি। তদুপরি দেশ গঠন, দেশ জয়, গঠনমূলক কাজ ও সাম্রাজ্যের সুদৃঢ় মূলক কাজে আত্মনিয়োগ-এসব বৃহৎ কাজে প্রায় সকলে ব্যস্ত ছিলো। যোগ্যতা ও প্রতিভা থাকার পরও রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বাত্মক ঝামেলায় নিজেকে নিয়োজিত করার পর তাঁদের স্ব স্ব কাব্য-রচনার যোগ্যতা আজকের যুগের অনেক কবিদের মতো ব্যবহার করতে পারেন নি।
টীকা ও তথ্যনির্দেশিকা :
* প্রভাষক, আরবী ও ফার্সী বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়৷
[1] আল-শূ‘আরাঃ ২৬/২২৪-২৬৷
[2] ইয়াসীনঃ ২৬/৬৯৷
[3] ‘আন আবী হোরায়রাতা কালা কালা রাসুলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু তা‘লা আলায়হি ও সাল্লাম লি আন ইয়াম তালিয়া জওফু রাজুলিন কি’হান ইয়ারিয়াহু খায়রুন মিন আন ইয়ামতালিয়া শি‘রান মুত্তাফাকুন আলাইহি৷ আল-হাদীসঃ মিশ্কাত মাস্বাবীহঃ বাবুল ওয়াশ্রেঃ পৃঃ ৪০৯৷
[4] “ফাকাদ্দামাহু জাতা ইয়াউমিন ইলা আমীরিল মু’মিন আলীয়্যিন বা’দা ওয়াকি আতিল জমলি ইফতিখারান বিজুদাতি শি‘রিহি ‘আলা সিগরিহী, ফাকালাল্লাহু (আ.) ‘আক-রি’ হুল কুরআনা ফ হুয়া খায়রুন লাহু৷” আহমদ হাসান যয়্যাতঃ তারাখু আদাবিল ‘আরবীঃ পৃঃ ১৬৪৷
[5] “চুনানচে ‘আম মুছলমানুনে শে’রগোয়ী আওর শায়ি‘রী কো বরান করনে ছ পহলু তাহী কর লিয়া৷” ইসলামের ইতিহাস ও আরবী সাহিত্যের ইতিহাসের ওপর লেখা যে কোন বই পড়লে এ তথ্য জানা যায়, যেমন-আহমদ হাসান যয়্যাতঃ তারীখু আদাবিল আরাবীঃ পৃঃ ১৭৬ : (উর্দু অনুবাদকঃ আঃ রহমান সুরতী)
[6] শ্রী সচন্দ্র দাসঃ সাহিত্য সন্দর্শনঃ সম্পাদনাঃ অধ্যাপক ম. ইসলাম পৃঃ ৩১৷
[7] শ্রী সচন্দ্র দাসঃ সাহিত্য সন্দর্শনঃ সম্পাদনাঃ অধ্যাপক ম. ইসলাম পৃঃ ৩০৷
[8] শ্রী মোহিত লাল মজুমদারঃ স্মর-গরল, শ্রী সচন্দ্র দাসঃ সাহিত্য-সন্দর্শন পৃঃ ৩৬৷
[9] শ্রী সচন্দ্র দাস, সাহিত্য সন্দর্শনঃ প্রাগুক্তঃ পৃঃ ৩৮৷
[10] ইসলামের ইতিহাসের ওপর লেখা যে কোন বই পাঠ করলে স্বাভাবিক ভাবে এ সত্য প্রকাশ পায়-প্রবন্ধক৷
[11] আ.এ. নিকলসনঃ এ লিটাৠারী হিস্ট্রী অব দা এরাবসঃ অনুঃ ৩, পৃঃ ৭১৷
[12] আ.এম. মুছলেহদ্দীনঃ আরবী সাহিত্যের ইতিহাসঃ পৃঃ ৩২৷
[13] মিশ্কাতুল-মাসবাবীহঃ বাবু-ফযায়ীলে সাইয়েদিল মুরসালীন, পৃঃ ৫১৭৷ “ও ‘আন জাবিরিন (রা.) আম্মান, নাবীয়্যা (সা.) কালা ইন্নাল্লাহা তা‘য়ালা বা ছানী লিতামামি মাকারিমাল আখলাকি ও কামালি মুহাসিনিল আ’মাল, রাওয়াহু ফি শাহ হিসসুন্নাহ৷”
[14] “ইন্নাকা লা’আলা খুলুকিন আজীম৷ আল-কা’লমঃ ৬৮/৩৷
[15] (ক) অধ্যাপক মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক : উচ্চতর আরবী ব্যাকরণ : পরি,৪র্থ-এর ভূমিকা, পৃ. ৩২।
[16] (খ)আল্লামাত তাহাভী : শরহে মা‘আনী আল-আছার, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৮০; করাচী সংস্করণ, ১৯৭০।
১৬ আ.এম. মুছলেহুদ্দীন : আরবী সাহিত্যের ইতিহাস : পৃ. ১৩০; আবুল ফারাজ ইস্পাহানী, কিতাবুল আগানী, খণ্ড-১৩,, পৃ. ৬৭; মুহাম্মদ আলী : দি হলি কুরআন : পৃ. 860।
১৭ আশ্শয়খ ইসমাইল হক্কী আল বরুছীঃ তাফসীবু রুহুল বয়ানঃ ১৯শ পারা, পৃঃ ৩১৭ “ও কানা আলীয়ুন (রা.) আশ্ আরার খুলাফায়ি৷”
১৮ আলীর দিওয়ান সম্মন্ধে ঐতিহাসিকদের ভিন্নমত রয়েছে, ‘আবদুল কাদীর জুরজানী বলেছেন, “আলীর (রা.) দিওয়ানের প্রথম কবিতা মুহাম্মদ-ইবন রবী আল মুস্বীলি কর্তৃক রচিত৷ আসসারুল বালাগঃ পৃঃ ২৯৪ সিয়ারু আনসারঃ ১ম খন্ডঃ পৃঃ ৩৪১, আ.এম.মুছলেহদ্দীনঃ আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, পৃঃ ১৩৩৷
১৯ ইবন-হিশামঃ সীরাতুন্নবী (সা.) খন্ডঃ -১, পৃঃ -১৭১৷
২০ ইবন-হিশামঃ সীরাতুন্নবী (সা.) খন্ডঃ -১, পৃঃ -৩৬২৷
২১ ইবন-হিশামঃ সীরাতুন্নবী (সা.) খন্ডঃ -২, পৃঃ -৩৭৪৷
২২ ইবন-হিশামঃ সীরাতুন্নবী (সা.) খন্ডঃ -২, পৃঃ -৩৬৪৷
২৩ উসদুল গা’বাঃ খন্ড-২, পৃঃ ৫৷ “ও রুওয়িয়া আন্নাল লাজিনা ইয়াহ জুনা রাসুলুল্লাহি (সা.) মিন কুরায়শিনঃ আবু সুফিয়ানুবনুল হারিছিবনি আবদিল মুত্তালিব ও আবদুল্লাহ, ঈবনযযিব আরী ও আমরুবনুল আস ও দারারুবনুল খাত্তাব”৷
২৪ আহমদ-হাসান যয়্যাত : তারীখু আদাবিল আরাবী : পৃঃ ১৫২৷ কালা লি আসহাবিহী মা ইয়ামনাউল লাজীনা নাসারুল্লাহা ও রাসুল্লাহু বি আসলিহাতি হিম আন ইয়ানসুরুহু বি আলসিনাতিহিতম? উসদুল গাবা খন্ডঃ ২ পৃঃ ৫, এতে নিম্নলিখিতভাবে উল্লেখ আছে- কালা মা ইয়ামনা উল কওমাল্লাজীনা নাসারু রাসুলাল্লাহি (সা.) বি-আস্ ইয়াফিহিম আন ইয়ানসুরুবি আলসিনাতিহিম!”
২৫ ইবনুল আসীর আ.হ.আলী মুহাম্মদ আলজযরী- উসদুল গা’বাঃ খন্ডঃ ২ পৃঃ ৬৷ “ফানতাদাবা লি হুজুয়িল মুশরিকীনা ছালাছাতুন মিনাল আনসীরিঃ হসিমান ইবনু ছাবিত ক’ব ইবনু মালিক ও আবদুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা৷”
২৬ ইবনুল আসীর আ.হু. আলী মুহাম্মদ আলজযরী- উসদুল গা’বাঃ খন্ডঃ ২ পৃঃ ৬৷ “আতাফা কানা হাসসান ও ক’ব ইয়ু আরিদানিহিম, মিছলা কওলিহিম ফিল ওকায়ি’ওল আইয়্যামি ওল মাছিরি ও ইয়াজকুরনা মিছালাহুম, ওকানা আবদুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা ইয়ু ইরুহুম বিল কুপরি ও বিইবাদাতিল মা লা ইয়াযনা’উ ওলা ইয়ানফাও৷”
২৭ আল-মিশকাতুল মাছাবীহ বাবুল-বয়ান ওয়শ্ শিরঃ পৃঃ ৪০৯৷ “ওআন আয়িশাতা (রাদিয়াল্লাহু তা’লা আনহা) কালাত কানা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ও সাল্লামা ইয়াদাউ৷ লি হাসসানা মিম্বারান ফিল মাসজিদি ইয়াকুমু আলায়হি কায়িমান ইয়ুফাখিরু আন রাসুলিল্লাহি (সা.) ইন্নাল্লাহা য়ু আ�
#সংগ্রহেঃ
নাছির বিন ইব্রাহীম
Chittagong
সংগ্রহেঃ নাছির বিন ইব্রাহীম
------------------------------
মহিলা কবি খানসার প্রতি সমর্থন :
প্রখ্যাত মুখাদরাম মহিলা কবি খানসা শোক-গাঁথা রচনায় শীর্ষস্থানীয়া ছিলেন। আপন গোত্রীয় লোকদের সাথে ইসলাম গ্রহণ করার জন্যে রসুলুল্লাহর (সা.) দরবারে আসেন। গোত্রীয় লোকগণ গর্বভরে হযরতের নিকটে খানসার রচিত কবিতা ও কাব্য-প্রতিভার সুখ্যাতি করেন। এতদশ্রবণে খানসাকে হযরত (সা.) তার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করার নির্দেশ দেন। আদিষ্ট হয়ে খানসা আবৃত্তি শুরু করেন। তিনি একটু বিরত হয়ে রসুল ‘ওয়া খানসা’ (খুনাস) বলে আরো আবৃত্তি করার জন্যে উৎসাহিত করতেন[31]। এ ভাবে তিনি কবি খানসার প্রতি সমর্থন দেন।
আদর্শ-কবিকে পুরস্কৃত করেছেন[32] :
কা‘ব ইবন জুহায়র (রা.) ইসলাম কবুল করতে এসে মদীনার মসজিদে হযরত মুহাম্মদের (সা.) প্রশংসায় এক সুদীর্ঘ কাস্বীদা পাঠ করেন। যার প্রারম্ভিক স্তোত্রটি ছিলো :
“বানাত সু‘য়াদু ফা কালবিল ইয়াউমা মত্বুলু + মুতায়্যামুন ইসরাহা লম্ ইয়ুফদা মক্বুলু।”
অর্থাৎ : ‘সুয়াদ’ চলে গেছে, বিরহ-ব্যথায় আমার অন্তর আজ বিদীর্ণ, আমি শৃঙ্খলাবদ্ধ, প্রেমের বন্দী, আমার মুক্তিপণ দেওয়া হয়নি। কা’ব যখন নিম্ন চরণটি আবৃত্তি করলেন-
“ইন্নার রাসুলা লনূরুন ইয়ুসতাদাও বিহী* মুহান্নাদুন মিন সুয়ু-ফিল্লাহি মসলুলু।”
অর্থাৎ : নিশ্চয় রসুল (সা.) আলোক, তাঁর দ্বারা আঁধার দুর হয়। তিনি আল্লাহর তরবারি সমূহ থেকে একটি কোষ-মুক্ত ধারালো অশি। উক্ত কাস্বীদা শ্রবণ করে রসুলুল্লাহ (সা.) আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে স্বীয় চাদর খানা পরবর্তী সময়ে ক‘অবের বংশধরদের নিকট থেকে আমীর মু‘আভীয়া চল্লিশ হাজার দিরহাম দিয়ে খরিদ করে নেন। উমাইয়া খলীফা ও আব্বাসীয় খলীফা এবং উসমানীয় খিলাফত পর্যন্ত এটা হস্তান্তরিত হতে থাকে ও মুসলিম খলীফাগণ রাজ্যাভিষেকের সময় বরকত লাভের আশায় চাদরটি পরিধান করতেন[33]।
হযরত স্বয়ং কবিতাবৃত্তি করেছেন :
এ কথা সত্য যে, মুহাম্মদ (সা.) অভ্যাস কবি ছিলেন না। তবুও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, তিনি শুধু মাত্র আদর্শ কবি ও কবিতাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহ প্রদান করেননি; বরং মাঝে মাঝে নিজেও কবিতাবৃত্তি করেছেন। যেমন :
(ক) হযরত বররা (রা.) বলেন, খন্দকের দিন হযরত রসুলুল্লাহ (সা.) মাটি সরাচ্ছিলেন-এতে তাঁর পবিত্র দেহ ধূলি-ধূসর হয়ে যায়, তখন তিনি আবৃত্তি করছিলেন[34]–
“ওয়াল্লাহি লও লাল্লাহু মাহ্ তাদায়না* ওলা তাসাদ্দাকনা ওলা সাল্লায়না,
ফানঝিলান সাকিনাতান্ ‘আলায়না* ও চাব্বিতিল আকদামা ইন লাকায়না,
ইন্নাল ঊলা কদ্ কাউ ‘আলায়না* ইজা আরাদূ ফিতনাতান আবায়না।”
অর্থাৎ : আল্লাহ শপথ, যদি আল্লাহ না থাকতেন, আমরা না সৎ পথ প্রাপ্ত হতাম, না দান-ছদকা করতাম, না উপাসনা-অর্চণা করতাম। হে আল্লাহ আমাদের মনে শান্তি দাও, জিহাদের ময়দানে আমাদেরকে দৃঢ় রাখো, পূর্ব সুরীগণ আমাদের সাথে বাড়া-বাড়ি করছে। তারা যখন বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চাইলে আমরা তাদেরকে এড়িয়ে চললাম[35]।
(খ) হযরত আনাস (রা.) বলেন, মুহাযির ও আনসারগণ খন্দক খুঁড়ছিলেন ও মাটি সরাচ্ছিলেন, আর আবৃত্তি করছিলেন –
“নাহনুল্ লাজি-না বায়া‘উ মুহাম্মাদান* ‘আলাল যিহাদি মা বাকায়্না আবদান।”
অনুবাদ : আমরা সেই সে দল যারা এ মর্মে মুহাম্মদের (সা.) হস্তে শপথ বাক্য উচ্চারণ করেছি যে, আ-মৃত্যু জিহাদ করে যাবো। এতদ শ্রবণে হযরত (সা.) বলেছেন[36]–
“আল্লাহুম্মা লা ‘আইশা ইল্লা ‘আয়শুল আখিরাহ* ফাগ ফিরিল আনসারা ওল্ মুহাজিরা।”
অর্থাৎ : হে আল্লাহ। পরকালীন জীবনই প্রকৃত জীবন, আনসার ও মুহাজিরদেরকে মার্জনা করো।
(গ) হযরত আবু হুরায়রা বলেন, রসুলুল্লাহ বলেছেন, কবির সে উক্তিই সর্বাধিক সত্য-যা লবীদ বলেছেন[37]–
“আলা কুল্লু শাইয়িন মা খালাল্লাহি বাতিলুন* ও কুল্লু ন‘য়ীমিন লা মহালাতা ঝায়িলুন।”
অর্থাৎ : আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই নিরর্থক, আর সব নি‘য়ামতই নিশ্চয় অপসৃত হবে।
(ঘ) হযরত মুহাম্মদ (সা.) হোনায়নের ময়দানে আবু সুফিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন[38]–
“আনান্নাবী লা কাজিব* আনা ইবনু ‘আব্দুল মুত্তালিব।”
অর্থাৎ : আমি নবী, মিথ্যাবাদী নই, আমি আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর।
(ঙ) আমর ইবনু শুরাইদ স্বীয় জনক আশ্শুরাইদ থেকে উদ্ধৃত করেন, আমি একদিন একই সওয়ারীতে রসুলের (সা.) পশ্চাতে উপবিষ্ট ছিলাম। রসুল (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “উমাইয়া ইবনু আবী সসিলতের কবিতা কি তোমার জানা আছে?” আমি বললাম, হ্যাঁ, তা জানা আছে। হযরত আমাকে তা আবৃত্তি করার আদেশ করলেন, আমি একটি পংক্তি আবৃত্তি করলাম। রসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে আরো আওড়াতে বললেন, আমি আরো একটি পংক্তি আবৃত্তি করলাম। রসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে আরো আওড়াতে বললেন, আমি এভাবে উক্ত দিবস হযরতকে (সা.) উমাইয়া বিরচিত একশটি কবিতা পংক্তি আবৃত্তি করে শোনালাম[39]। অন্যত্র উমাইয়া সম্মন্দে রসুল মন্তব্য করে বলেছেন, “তার ভাষা ঈমানদার হয়েছে আর তার হৃদয় কাফের রয়েছে[40]।”
হযরত কবিতাকে জিহাদের হাতিয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
‘ইস্তিয়াব’ গ্রন্থে ইবন-আবদুল বার উল্লেখ করেছেন, রসুলুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলাম, “কবিতা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?” প্রত্যুত্তরে রসুল (সা.) বললেন, “মু‘মেন তো স্বীয় তরবারি ও জিহবার সাহায্যে জিহাদ করে[41]।”
হযরতের (সা.) প্রাণ-প্রিয় সাহাবাগণ কবিতার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ঃ-
রসুলের (সা.) প্রাণ-প্রিয় সাহাবাগণও কবিতার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তাঁদের কেহ কেহ কবিতা রচনা করেছেন। কে.এ.ফারিক আল-শা‘বীর (মৃত্যু-১০৩/৭২১) সূত্রে উল্লেখ করেছেন, “প্রথম চারজন খলীফার সকলই কবি ছিলেন[42]।”
ইবন-ইসহাক হযরত আবু বকরের (রা.) রচিত একটি কবিতার উল্লেখ করেছেন। কবিতাটি ‘উবায়দা-ইবনু-হারিসের’ গযওহকে উপলক্ষ করে রচিত। এর কিছু অংশ নিম্নরূপ[43]–
“রসুলুন আতাহুম ফাতাকজিবু *‘আলায়হি ও কালু লসতা ফি-না বি মাকিছি,
ইজা মা দা‘আউনাহুম ইলাল্ হাককি আদবারো* ওয়া হারাউ হারিরাল মুজহিরাতিল লওয়াহিবি।”
অর্থাৎ ঃ তাদের নিকট সত্য রসুল (সা.) এসেছেন, কিন্তু তারা তাঁকে অমান্য করেছে ও বলেছে, তুমি আমাদের এথায় থাকতে পারো না। যখন আমরা তাদেরকে সত্যের প্রতি আহ্বান করেছি, তোমরা কুকুরের মতো পশ্চাৎপসারণ করেছ। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক এ কবিতা আবু বকরের (রা.) বলে মানেন না।
কে.এ.ফারিক হযরত আবু বকর (রা.)-এর আর একটি কবিতার কথা উল্লেখ করেছেন। উক্ত কবিতায় হযরত আবু বকর (রা.) ‘আবু জনদল’ নামক জনৈক সেনাধ্যক্ষকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন[44]–
“নফসসুন ‘ইসামুন সাউয়্যেদাত্ ই‘সামান ও ‘আউয়্যেদাতহুল কুররু ওল ইকদামা।”
অর্থাৎ : ইসলামের বীর পুরুষগণ তাদেরকে জন্ম দিয়েছেন, আর বারংবার আক্রমণ ও অগ্রগামীতা তাদের বৈশিষ্ট্য।
হযরত আ‘য়িশা (রা.) থেকে হযরত আবু বকর (রা.)-এর একটি কবিতা পংক্তি বর্ণিত আছে[45]–
“কুল্লুমরিয়িন মুসবিহুন ফি আহলিহী ওয়াল মউতু আদনা মিন্ শিরাকিনি আলিহী।”
অর্থাৎ : প্রত্যেক ব্যক্তি স্বীয় পরিবার-পরিজনের মাঝে এমতাবস্থায় প্রত্যুষে গাত্রোত্থান করে যে, মৃত্যু তার জুতুর (পাদুকার) ফিতা (পাদুকার উপরিভাগে চামড়ার লম্বা টুকরা) অপেক্ষাও অতি নিকটবর্তী প্রতীয়মান হয়।
হযরত ওমর (রা.) কবিতা সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখতেন, কিন্তু তিনি কোন কবিতা রচনা করেছেন-এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাঁর সময়কার প্রশাসকদের তিনি ফরমানের মাধ্যমে কবি গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করতেন। বসরার গভর্ণর আবু মুসা-আল-আশ‘আরীকে এক লিখিত ফরমানে তিনি জানান[46]–
“মুর্ মান্ কাবলাকা ইয়াতা‘ল্লাম্শশিরা ফাইন্নাহু ইয়াদুল্লু ‘আলা মা-‘আলীয়্যিল্ আখলাকি ও সওয়াবিররা-ই ও মা’রিফাতিল আনসসাবি।”
অর্থাৎ : তোমার সেখানকার লোকদেরকে কবিতা শেখার জন্যে নির্দেশ দাও, কবিতা, উন্নত চরিত্র, সঠিক সিদ্ধান্ত ও আরবদের বংশ পরিচয়ের সঠিক ধারণা প্রদান করে। অন্যত্র আছে, তিনি প্রাদেশিক শাসন-কর্তাদের নিকট এ মর্মেও ফরমান পাঠাবেন, “তোমাদের সন্তান-সন্ততীদেরকে কবির উত্তম বর্ণনা ও প্রচলিত আরবী প্রবাদ-বাক্য বর্ণনা করে শোনাও[47]।” হযরত ওমরের কাব্য-নির্বাচন ক্ষমতা অত্যন্ত প্রখর ছিলো। একবার গাতকান গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল হযরত ওমরের সাক্ষাৎ লাভ করার জন্যে আসেন। বলা বাহুল্য, উক্ত গোত্র মু‘আল্লাকা যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ও কাব্য-নির্বাচক ‘আল-নাবিঘার’ গোত্র ছিলো। হযরত ওমর (রা.) উক্ত প্রতিনিধিদলকে এ মর্মে প্রশ্ন করলেন যে, “তোমাদের গোত্রের শ্রেষ্ঠ কবি কে?” প্রতিনিধি দলটি প্রত্যুত্তরে জানালেন, “হে বিশ্বাসীগণের নেতা, আপনি এ বিষয়ে আমাদের অপেক্ষা উত্তমভাবে নির্বাচন করতে পারেন[48]।” এ আলোচনার দ্বারা বুঝা যায় হযরত ওমর (রা.) কত বিশ্বস্ত ও কাব্য নির্বাচক ছিলেন।
খলিফা ওসমান গণি (রা.) কিছু কবিতার রচয়িতা বলে জানা যায়, বিদ্রোহীদের দ্বারা গৃহ-বন্দী অবস্থায় তিনি হযরত আলীর নিকট লিখিত এক পত্রের শেষ ভাগে লিখেছেন[49]–
“ফা-ইন্ কুনতু মা‘কূলান ফাকুন আনতা আ’কিলী* ও ইল্লা ফাদ্রিকনী ওলাম্মা উমাঝ্যিকু।”
অর্থাৎ : আমি যদি খাদ্য-বস্তু (হত্যার উপযুক্ত) হই, হবে তুমিই আমাকে ভক্ষণ (হত্যা) করো। আর যদি এরূপ না হই; তবে, আমি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হবার পূর্বে আমাকে রক্ষার জন্যে এগিয়ে আসো।
হযরত আলী ছিলেন আরবী সাহিত্যের একজন বড় ব্যক্তিত্ব। আল-বরুছী তাঁকে খুলাফায়ে রাশেদীনদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। নাহজুল বালাগায় তাঁর অসংখ্য কবিতা পাওয়া যায়। হাদীস, লুঘাত ও আরবী সাহিত্যের কিতাবে তাঁর অসংখ্য কবিতা রয়েছে। নিম্নে তাঁর রচিত রাজছন্দের একটি কবিতাংশ উল্লেখ করা গেল :
“লা ইয়াসতাওয়ী মান্ ইয়া‘মুরুল মাসাজিদা * ও ইয়াদ্ ‘আবু ফি-হা কায়মান ও কায়িদান”
ওমান ইয়ুরা ‘আনিল গু’বারি হায়িদান।”
কে.এ.ফারিক, তদীয় হিস্ট্রী অব এরাবিক লিটারেচার গ্রন্থে কবিতাটি উল্লেখ করেছেন নিম্নরূপে :
“লা ইয়াস্তাওয়ী মান্ ইয়া‘মুরুল মাসাজিদা * ও ইয়াদ্ ‘আবু ফিহা কায়িমান ও কায়িদান,ওমান ইয়ুরা ‘আনিততুরাবি হায়িদান।”
অর্থাৎ : তিনি গোবারি-এর স্থলে ‘আনিততুরাবি উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে উভয় শব্দের ভাবার্থ এক।
অনুবাদ : যিনি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং এ জন্যে সবাবস্থায় সাধনা করেন, অথচ তিনি সে ব্যক্তির সমকক্ষ নহেন ; যিনি বালির স্তুপকে পরিহার করে চলেন বলে পরিদৃষ্ট হন[50]।
আলী-তনয় হযরত হাসানও (রা.) কবিতা রচনা করতেন। একবার তিনি দাড়িতে কলপ লাগিয়ে বাইরে আসেন। উপস্থিত লোকেরা তাঁর দিকে দেখতে থাকলে তিনি বললেন[51]–
“নাসুদু আ‘লাহা ও তা’বা উসুলুহা * ফালায়তাল্লাজী ইয়াসুদু মিনহা হুয়াল আসলু।”
অর্থাৎ : আমরা চুলের উপরাংশে কলপ দেই, কিন্তু চুলের মূল সে কলপ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। আহা, যদি চুলের মূলও কালো হতো।
কা’ব ইবনু মালিক (রা.) ‘আমের‘কে উদ্দেশ্য করে বলেন[52]–
“মা‘আজাল্লাহি মিন্ ‘আমালিন্ খাবিছিন্ * কাসা‘য়্যিকা ফিল ‘আশিরতি ‘আবদ ‘আমর
ফা আম্মা কুলতুলি শরফুন ও নহলুন * ফা কদ্ মা বি’তু ঈমানান বি কুফ্রিন।”
অর্থাৎ : তুমি যেমন ‘আবদু’ আমর গোত্রের দুর্নাম করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে, তোমায় এহেন নিকৃষ্ট কাজ থেকে আমি খোদার নিকট আশ্রয় চাই। আমি তো বলি যে, আমার জন্যে সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত এবং আমি কুফুরীর বিনিময়ে সম্মান বিক্রয় করিনি।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন জজুরাযর আল-আসাদী পবিত্র কুরআনের আয়াত- “ইন্না শাজারাতাঝ্ ঝাক্কুম তা‘আমুল আছিমি কাল মুহলি ইয়াগলি ফিল বুতুন” এ উক্তি “আল মুহলি” শব্দের ব্যাখ্যায় রচনা করে বলেন[53]–
“ফামান ‘আশা মিনহুম ‘আশা ‘আবদান ও ইন্ ইয়ামুত * ফাফিন্নারী ইয়ুসকা মুহলুহা ও সাদীদুহা।”
অর্থাৎ : তাদের (বিধর্মী) জীবিতগণ দাস-জীবন অতিবাহিত করছে, আর মৃতগণ জাহান্নামের মাঝে পূঁজ ও গলিত বস্তু ভক্ষণ করছে।
ইসলাম দীক্ষিত হবার পর হযরত আব্বাস ইবন মিরদাস বলেছেন[54]–
“ফা-ইন্ তাকু কদ্ আমমারতা ফিল্ কউমি খালিদান * ও কদ্দামতাহু ফাইন্নাহু কদ্ মুকাদ্দামান,
বিজুনদিন্ হাদাহুল্লাহু আনতা আমীরুহু * ইয়াসিবু বিহিল হক্কা মান কানা আজলামা।”
অর্থাৎ : (হে আল্লাহর নবী) খালিদকে (রা.) যদি আপনি গোত্রের নেতা মনোনীত করেন এবং তাঁকে প্রাধান্য দেন, (তাহলে) নিশ্চয় সে অগ্রগামী। সে এমন একটি সেনাদল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, যে দলকে মহান আল্লাহ সঠিক পথ দান করেছেন, আর আপনি হচ্ছেন উক্ত দলের আমীর।
হযরত আউন-ইবন-আইয়ুবুল ‘আনসারী, আকাবার দ্বিতীয় শপথের দিন বারা-ইবন-মারূরের প্রশংসায় বলেছেন[55]–
“ও মিন্নাল মুসাল্লিও আওয়্যালুননাসি মুকবিলান * ‘আলা কা‘বাতির রাহমানি বাইনাল মাশা’য়িরি।”
অর্থাৎ : সর্ব প্রথম নামাযী আমাদের লোক করুণাময়ের কা‘বামুখী হয়ে নামায আদায় করেছেন- যে কা’বা মহান আল্লাহর নিদর্শনসমূহের একটি।
হোনায়নে মুসলমানদের বিজয়ের পর জনৈকা মুসলিম রমণী বলেন[56]–
“কদ্ গালাবাত্ খায়লুল্লাহি খয়্ লুললাতি * ওয়াল্লাহু আহাক্কু বিসছিবাতি।”
অর্থাৎ : আল্লাহর অশ্বারোহী (সেনা) দল লাতের (শিরকের) অশ্বারোহী দলকে পরাভূত করেছে, আর আল্লাহই হলেন অনাদী ও অনন্ত। হযরত বুযায়র (রা.) স্বীয় ভ্রাতা ক’বকে লিখেন :
“মান মুবলিগ ক’বান ফহাল লাকা ফিললাতি * তালুমু ‘আলাইয়্যা বাতিলান ও হিয়া আহঝাম,
ইলাল্লাহি লাল্‘ওজ্জা ও লাললাতি ওহদাহু * ফাতনজু ইজা কানান নাজাউ ও সল্লিমু।”
অর্থাৎ : ক’বকে এ মর্মে এ বাণী কি কেউ পৌঁছে দেবে যে, তুমি আমাকে এমন এক বিজয়ের অসারতার বিষয়ে ধিক্কার দিচ্ছো- অথচ সে বস্তুই সঠিক? এক, অদ্বিতীয় আল্লাহর পথে ফিরে আসো, লাত ও ওজ্জার পথে নয়। তা হলে, যখন মুক্তি আসবে, মুক্তি ও নিরাপত্তা পাবে।
লবীদ (রা.) : মু‘আল্লাকা যুগের মধ্যমণি কবি লাবীদ সম্মন্ধে আর.এ.নিকলসন বলেন, “ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি এ বলে কবিতা শপথ পূর্বক পরিত্যাগ করেন যে, মহান আল্লাহ আমাকে (কবিতার পরিবর্তে) কুরআন দান করেছেন”[57]। হযরত ওমর যখন লবীদকে (রা.) লিখে পাঠালেন, “তোমার কবিতা আমাকে আবৃত্তি করে শোনাও।” কবি লবীদ (রা.) সুরা বাকারা আবৃত্তি করে শোনালেন আর বললেন, “আল্লাহ যখন আমাকে বাকারা ও আল-ইমরান সুরাদ্বয় লিখবার তওফিক দিয়েছেন, আমি আর কবিতা বলবোনা।” বলা বাহুল্য, ওমর (রা.) এতে সন্তুষ্ট হয়ে লবীদের ভাতা পাঁচশ দিরহামে উন্নীত করেন[58]। জুরজী যায়দান তদীয় তারীখু-আদাবিল-লুগাল-আরাবীয়া গ্রন্থে আহমদ হাসান যয়্যাত তদীয় তারীখু-আদাবিল-আরাবী গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, লবীদ ইসলাম গ্রহণ করার পর নিম্ন পংক্তিটি রচনা করেছেন[59]।-
“আল্হাম্দু লিল্লাহি ইজলাম ইয়া’তিনী আজালী * হাত্যা লাবিসতু মিনাল ইসলামি সিরবালা।”
অর্থাৎ ঃ মহান আল্লাহর প্রশংসা, ইসলামে দীক্ষিত হবার পূর্বে তিনি আমাকে মরণ দান করেন নি।
এ কথা সত্য যে, হযরত লবীদ ইসলামে দীক্ষিত হবার পর তাঁর ইসলাম পূর্ব যুগের মতো কাব্যকে জীবন-লক্ষ্য হিসেবে, উপজীবিকার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন নি। তবে, প্রয়োজনে দু’একটি পংক্তি রচনা করেছেন। পবিত্র কুরআনের আলংকারিক সৌন্দর্য ও প্রাঞ্জলতায় অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনি কুরআনের শিক্ষায় সর্বাধিক মনোনিবেশ করেছিলেন। অথচ জুরজী যায়দান ও যয়্যাতের বর্ণনা মতে এ কথা বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি মুসলমান হওয়ার পর মাত্র ও পংক্তিটুকুই রচনা করেছিলেন।
হযরত আবু দুজানা (আসল নাম সিমাক ইবন খারাশা-আল-আনসারী-আলসা আদী) ওহুদের ময়দান রসুল (সা.) তাঁকে স্বীয় তরবারী প্রদান করলে তিনি বলেছেন[60]–
“আনাললাজি ‘আহাদানী খলিলী * ও নাহনু বিসসফহি লদাননাখীলি;
আন লা আকুমাদদাহরা ফিল্ কুয়ূলি * আদ’বির বি সাইফিল্লাহি ওর্ রসুলি।”
অর্থাৎ : আমরা খেজুর বৃক্ষের নীচে সমতল ভূমিতে অবস্থানরত অবস্থায় আমার বন্ধুর সাথে এ মর্মে শপথ করলাম যে, আমি কখনো পশ্চাৎসারিতে দাঁড়াবোনা, আল্লাহ ও তদীয় রসূলের অশি দ্বারাই আঘাত হানতে থাকবো।
ইসলামে দীক্ষিত হবার পর হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবনুজজিব আরী (রা.) রসুলে করীমকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন[61]–
“ইয়া রসুলাল মালীকি ইন্না লিসানী * রাতিকুন মা ফানাকাত ইজ্ আনা বুরু,
আনা বারিয়ু শশায়তানি ফি সুননিল্ * গাইয়্যি ওমান্ মালা ময়লাতান মসবুরু
আ-মানাল্লাহমু ওয়াল ইজামু লিরাব্বী * ছুম্মা কালরীশশহীদু আনতান নজীরু,
ইন্নানী আনকা ঝাযেরুন ছুম্মা হাইয়্যান * মিন লিওয়ায়িন ও কুল্লুহুম মগবুরু।”
অর্থাৎ : হে আল্লাহর রসুল (সা.) নিশ্চয় আমার ভাষা অক্ষম, এখনো ধ্বংস হয়নি, অথচ; আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। শয়তান যখন পথ ভ্রষ্টতার প্রতিযোগিতা করে- যে এ পথে আকৃষ্ট হয় সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আমার অস্তি ও মজ্জা আমার প্রভুর ওপর ঈমান এনেছে। অতঃপর আমার অন্তর সাক্ষী দিচ্ছে যে, আপনি একজন ভয়-প্রদর্শক। আমি আপনার পথ থেকে লওয়াই গোত্রকে (আল্লাহ ও পরকালের) ভয়-প্রদর্শন করবো-অথচ, তারা সবাই অহংকারী। ইসলামে দীক্ষিত হবার পর হযরত ‘ফুজালা’ : স্ত্রীকে বলেন[62] :
“কালাত হালুম্মা ইলাল হাদীছে ফা কুলতু লা,
ইয়া‘বা ‘আলায়কিল্লাহু ওয়াল ইসলামু,
লও মা রাআয়তি মুহাম্মাদান ও কবীলাহু,
বিল্ ফতহি ইয়াওমা তুকছিরুল আসনামা।
লারাআয়তি দ্বীনাল্লাহি আদহা বাইয়্যেনান,
ওশশিরকু ইয়াগশা ওজহাহু লিআজলামি।”
অর্থাৎ : আমায় সে আহবান করে বললো, এসো আলাপ করি, আমি বললাম, না, আল্লাহ ও ইসলাম তোমাকে সংগদান অস্বীকার করেন। মক্কা বিজয়ের দিন, যেদিন মুহাম্মদ (সা.) (ও তাঁর সহচরগণ) মূর্তি সমূহকে ভাঙ্গছিলেন যদি তুমি তিনি ও তাঁর গোত্রকে দেখতে, তবে তুমি দেখতে আল্লাহর মনোনীত ধর্ম (ইসলাম) উজ্জ্বল এবং শিরকের অবয়ব অন্ধকারে আচ্ছাদিত।
নবী নন্দিনী ফাতিমাতুয যোহরা (রা.) রসুলে খোদার (সা.) ওফাতের পর মর্মিয়ামর্ধী না’ত রচনা করেন, তার অনুবাদ কবিতাকারে নিম্নরূপ[63] :
“যে কেউ সুঘ্রাণ নেয় নবীর মাযারে একবার,
লাগবেনা ভালো তার পৃথিবীর কোন ঘ্রাণ আর।
দারুণ আহত আমি, হৃদয়ে এমন অন্ধকার-
দিবসে পড়তো যদি সে আঁধার কণা পরিমাণ,
তা হলে দিবস হতো চিরতরে রাত্রির সমান।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবন রওয়াহা রচনা করেছেন অগণিত কবিতা, নিম্নে তাঁর রচিত একটি পংক্তি নমুনা স্বরূপ পেশ করা গেল :
“খালফাসসালামি আলা ইমরিইন ওদ্দা‘আতুহু * ফিননাখীলি খায়রু মুশায়্যি‘য়ুন ও খলীলু।”
অর্থাৎ : আমি এমন এক ব্যক্তির সালামের জবাব দিয়েছি, যাকে আমি খেজুর বৃক্ষের নীচে উত্তমভাবে বিদায় দিয়েছি, তিনি হলেন একজন উত্তম বন্ধু।
মহানবী (সা.) শুধুমাত্র কবিতা ভালোবাসতেন না, বরং কবিতার যত্নবান হবার জন্যে এর মর্যাদা ও তাৎপর্যের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে[64]। হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা.) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। একদা নবীর (সা.) দরবারে পূর্বদেশীয় আগন্তুক আগমন করলো, তারা নবীর (সা.) সাথে সুস্পষ্ট বাক্যালাপ করলো, রসুলুল্লাহ (স.) বললেন, “বর্ণনায় যাদুশক্তি আছে, আর কবিতায় আছে প্রকৃষ্ট জ্ঞানের কথা[65]।”
পর্যালোচনা :
আমরা সামগ্রীক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথায় উপনীত হতে পারি যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কবিতা ভালোবাসতেন, তাঁর মধ্যে কাব্য প্রীতি ছিলো। সুতরাং ইসলামে কাব্য-চর্চা স্বীকৃত।
ইসলামে কাব্য চর্চা নিষিদ্ধ হলে ইসলামের নবী (সা.) আদর্শ কবিকে মসজিদে নব্বীতে পৃথক মিম্বার তৈরী করে দিতেন না, আদর্শ কবিকে পুরস্কৃত করতেন না। যেমন তিনি হযরত কা’বকে (রা.) স্বীয় চাদর দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজে কবিতা আবৃত্তি করেছেন। যেমন তিনি খন্দকের যুদ্ধের খন্দক খোড়াকালীন সময় কবিতা আবৃত্তি করেছেন। আদর্শ কবিতা আবৃত্তি করেছেন ও আবৃত্তি করায়ে শুনেছেন। যেমন- কবি লবীদের কবিতা নিজ মুখে আবৃত্তি করেছেন। উমাইয়া ইবন আবিসসিতের প্রায় একশটি কবিতা পংক্তি আগ্রহ ভরে শুনেছেন। রসুলের প্রাণ-প্রিয় সাহাবাগণও কবিতা আবৃত্তি করেছেন। নবী প্রয়োজনে তাদেরকে কবিতা চর্চার উৎসাহ প্রদান করেছেন। তদুপরী রসুল (সা.) স্বয়ং এক বাণীর মাধ্যমে কবিতাকে জিহাদের হাতিয়ার বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর কবিতা যদি ইসলামে নিষিদ্ধ হতো, তাহলে আল্লাহর রসুল (সা.) ও তাঁর সাহাবগণ কবিতার প্রতি এমন আগ্রহ উদ্দীপনা দেখাতেন না।
সিদ্ধান্ত : উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ইসলামে কাব্য-চর্চা নিষিদ্ধ নয়। তবে ইসলামে কবিতার গুণাগুণ পরখ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কবিতার বিষয়বস্তু। বিষয়বস্তু ভাল তথা কুরআন ও হাদীস সম্মত হলে সে কবিতা ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য। আর বিষয়বস্তু মন্দ তথা কুরআন-হাদীস সম্মত না হলে সে কবিতা বর্জনযোগ্য। আল্লামা শায়খ ইসমাইল হক্বী আল বরুসী তদীয় তাফসীরু রুহুল বযান গ্রন্থে আল কাওয়াশী থেকে উদ্ধৃত করেন[66]-কবিতা বাক্যগুচ্ছ, তার ভালোটা ভালো আর মন্দটা মন্দ। আর যদি কবিতার বিষয়বস্তু নিম্নলিখিত প্রকারের হয়, তবে সে কবিতা উত্তম বলে বিবেচিত হবে। যেমন :
১। আল্লাহর একত্ববাদের বর্ণনা তথা তাওহীদ,
২। পাঠক সমাজকে সৎচরিত্র অবলম্বনের প্রতি উৎসাহ দান,
৩। জিহাদের বর্ণনা,
৪। আল্লাহর উপাসনা-বন্দেগী,
৫। দায়িত্বানুভূতি তথা ফরজিয়াৎ,
৬। শালীনতা বোধ,
৭। আত্মীয়তা তথা রক্তের বন্ধন,
৮। মহানবী ও রসুলগণ এবং
৯। সৎ কর্মশীলদের যথাযথ প্রশংসার কথা সম্বলিত বিষয়বস্তু।
ইসলামে কাব্য-নির্বাচনের দৃষ্টিভঙ্গি তো এরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, “কবিতা সু-সামঞ্জস্য কথামালা, যে কবিতা সত্যনিষ্ঠ সে কবিতাই সুন্দর আর যে কবিতায় সত্যের অপলাপ হয়েছে সে কবিতাতে মঙ্গল নেই[67]।”
ইসলাম সামগ্রীক ভাবে কাব্য-চর্চা ইসলাম নিরোৎসাহীত করে। অধিকাংশ ধর্মবেত্তার (ওলামা) মতে, কাব্য চর্চা পছন্দনীয়, তবে নিম্নলিখিত বিষয়বস্তুর উপর রচিত কাব্য ইসলামে অপছন্দনীয় ও বর্জনীয়[68] :
১। মিথ্যা ও অবাস্তব কথাবার্তা,
২। কারো অহেতুক কুৎসা,
৩। মানুষকে খোদ-বিমুখ করে ও কুরআন পাঠ থেকে বিরত রাখে-এমন বিষয়বস্তু,
৪। অহেতুক প্রশংসার কথা,
৫। নিছক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কথা,
৬। অসংলগ্ন ও অশালীন উক্তি,
৭। মিথ্যা গুণে ভূষিত করার কথা,
৮। ভৎর্সনার কথা,
৯। মিথ্যা দোষারোপ করা,
১০। মিথ্যা অহংকারপূর্ণ বাক্য,
১১। হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী উক্তি,
১২। প্রদর্শনেচ্ছামূলক উক্তি,
১৩। লোভ-লালসার প্রকাশ,
১৪। নিম্ন ও হেয় কথাবার্তা,
১৫। অপদস্তমূলক বাক্য,
১৬। অযথা বংশ গৌরব,
১৭। মিথ্যা অহংকারের কথা ও
১৮। অশ্লীল উক্তি সম্বলিত বিষয়বস্তু।
মহানবীর (সা.) নিম্ন বাণীটি উক্ত ধারণাকে আরো সুস্পষ্ট করে তোলে- “কবিতা কথার মতোই। ভাল কথা যেমন সুন্দর, মন্দ কবিতা মন্দ কথার মতোই মন্দ[69]।” তিনি আরো বলেছেন, “কবিতা তো কথার মতোই কথা বিশেষ, কথার মাঝে কোনটা উৎকৃষ্ট হয় আর কোনটা হয় নিকৃষ্ট[70]।”
শ্রেষ্ঠ কবিতা পাঠে, পাঠক কবির সুগভীর আন্তরিকতা ও বিষয় তন্ময়তায় প্রবৃদ্ধ হয়। কবিতার অপর নাম জীবন-জিজ্ঞাসা বা জীবন দীপিকা। কাব্যের বিষয়বস্তু কাব্য-সৌন্দর্যকে ও সত্যকে প্রস্ফুটিত করে তোলে। তাই ইসলাম কবিতার গুণাগুণ বিচারের মানদন্ড হিসেবে বিষয়বস্তুকে নির্ধারণ করে নিয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ভালো করা যেমন সুন্দর ভালো কবিতাও তেমন সুন্দর। রসুলুল্লাহ এ উক্তি মূলতঃ মানব-কল্যাণে একটা সম্ভাব্য ইঙ্গিতবহ। অর্থাৎ, Arts for Arts sake (শিল্পের খাতিরে শিল্পের সৃষ্টি) এ চিন্তাধারার বিলুপ্তি সাধন করে Arts for life sake (জীবনের খাতিরে শিল্প) এ চিরন্তন সত্যটাই জোরদার করে।
উপসংহার : ইসলাম ফিৎরাতের ধর্ম। কবিতা মানব মনের সুকুমার বৃত্তির উন্নতি সাধন করে। ফিৎরাতের ধর্ম ইসলাম এ ক্ষেত্রে অবশ্যই নীরব থাকতে পারে না। প্রত্যেক বস্তুর দুটি গুণ রয়েছে; ভালো আর মন্দ। ভালো গুণ কল্যাণকর, তাই আগ্রহণীয়। আর মন্দ গুণ অকল্যাণকর, তাই তা বর্জনীয়। ইসলাম ধর্মে ভালো কবিতা গ্রহণযোগ্য আর মন্দ কবিতা বর্জনযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম সার্বিকভাবে কাব্য-চর্চাকে নিরুৎসাহীত করেনি। পবিত্র কুরআনই এর সাক্ষ্য। আলোচ্য সুরা আশ্-শুআরাতেই উক্ত আছে, “আর যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে এবং আল্লাহর স্মরণে অতিমাত্রায় তৎপর রয়েছে, আর অত্যাচারিত হলে নিজেদের আত্ম-রক্ষায় সচেষ্ট হয়েছে, তাদের সম্মন্ধে এ কথা প্রযোজ্য নয়[71]।” আলোচ্য আয়াতে নিম্নলিখিত চারটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কবি ও কবিতাকে ইসলাম স্বীকৃতি দিয়েছে, যথা :
১। সে ঈমানদার হবে, অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর রসুল এবং তাঁর কিতাবসমূহকে ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে মানবে ও বিশ্বাস করবে এবং ফিরিশতা ও পরকালের প্রতি সন্দেহহীন দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করবে।
২। সে নিজের বাস্তব জীবনে শত্যাদর্শ ও সত্যভাবের অধিকারী হবে। নৈতিক চরিত্রের সীমা লংঘন করে সে বলগা হারা অশ্বে পরিণত হবে না।
৩। সাধারণ সময় ও অবস্থায় খুব বেশী পরিমাণে মহান আল্লাহর স্মরণ করবে।
৪। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে কারো কুৎসা করবে না। তবে, জালেমদের বিরুদ্ধে সত্যকে সমর্থন করার প্রয়োজন দেখা দিলে সে তার কাব্যের দ্বারা সে কাজই করবে যা একজন স্বাস্থ্য মুজাহিদ তার হাতের অশি দ্বারা জিহাদের ময়দানে সম্পাদন করে থাকে।
আল্লামা তহাভী বলেন, “ফকীহগণের মত কুৎসা বা অশ্লীলতা বিবর্জিত কবিতা বর্ণনায় কোন দোষ নেই।[72]।”
ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবের মুসলমানদের মাঝে কবিতা চর্চা একটু স্তিমিত হয়ে পড়েছিলো এ কথা সত্য- এ কারণে কেহ কেহ হয়তো একথা মনে করে থাকবেন যে, ইসলাম কাব্য-চর্চাকে নিরুৎসাহিত করছে। কিন্তু এর সঠিক ব্যাখ্যা তা নয়, বরং পবিত্র কুরআনের প্রাঞ্জল-ভাষা, উৎকৃষ্ট বর্ণনা-কৌশল, চমৎকার উপমা-উৎপ্রেক্ষা, রূপক-ব্যবহার ও অলংকারময়তার সৌন্দর্যে আরবদের মন অভিভূত হয়ে পড়েছিলো। তাই তারা অন্য কিছুতে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পায়নি। তদুপরি দেশ গঠন, দেশ জয়, গঠনমূলক কাজ ও সাম্রাজ্যের সুদৃঢ় মূলক কাজে আত্মনিয়োগ-এসব বৃহৎ কাজে প্রায় সকলে ব্যস্ত ছিলো। যোগ্যতা ও প্রতিভা থাকার পরও রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বাত্মক ঝামেলায় নিজেকে নিয়োজিত করার পর তাঁদের স্ব স্ব কাব্য-রচনার যোগ্যতা আজকের যুগের অনেক কবিদের মতো ব্যবহার করতে পারেন নি।
টীকা ও তথ্যনির্দেশিকা :
* প্রভাষক, আরবী ও ফার্সী বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়৷
[1] আল-শূ‘আরাঃ ২৬/২২৪-২৬৷
[2] ইয়াসীনঃ ২৬/৬৯৷
[3] ‘আন আবী হোরায়রাতা কালা কালা রাসুলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু তা‘লা আলায়হি ও সাল্লাম লি আন ইয়াম তালিয়া জওফু রাজুলিন কি’হান ইয়ারিয়াহু খায়রুন মিন আন ইয়ামতালিয়া শি‘রান মুত্তাফাকুন আলাইহি৷ আল-হাদীসঃ মিশ্কাত মাস্বাবীহঃ বাবুল ওয়াশ্রেঃ পৃঃ ৪০৯৷
[4] “ফাকাদ্দামাহু জাতা ইয়াউমিন ইলা আমীরিল মু’মিন আলীয়্যিন বা’দা ওয়াকি আতিল জমলি ইফতিখারান বিজুদাতি শি‘রিহি ‘আলা সিগরিহী, ফাকালাল্লাহু (আ.) ‘আক-রি’ হুল কুরআনা ফ হুয়া খায়রুন লাহু৷” আহমদ হাসান যয়্যাতঃ তারাখু আদাবিল ‘আরবীঃ পৃঃ ১৬৪৷
[5] “চুনানচে ‘আম মুছলমানুনে শে’রগোয়ী আওর শায়ি‘রী কো বরান করনে ছ পহলু তাহী কর লিয়া৷” ইসলামের ইতিহাস ও আরবী সাহিত্যের ইতিহাসের ওপর লেখা যে কোন বই পড়লে এ তথ্য জানা যায়, যেমন-আহমদ হাসান যয়্যাতঃ তারীখু আদাবিল আরাবীঃ পৃঃ ১৭৬ : (উর্দু অনুবাদকঃ আঃ রহমান সুরতী)
[6] শ্রী সচন্দ্র দাসঃ সাহিত্য সন্দর্শনঃ সম্পাদনাঃ অধ্যাপক ম. ইসলাম পৃঃ ৩১৷
[7] শ্রী সচন্দ্র দাসঃ সাহিত্য সন্দর্শনঃ সম্পাদনাঃ অধ্যাপক ম. ইসলাম পৃঃ ৩০৷
[8] শ্রী মোহিত লাল মজুমদারঃ স্মর-গরল, শ্রী সচন্দ্র দাসঃ সাহিত্য-সন্দর্শন পৃঃ ৩৬৷
[9] শ্রী সচন্দ্র দাস, সাহিত্য সন্দর্শনঃ প্রাগুক্তঃ পৃঃ ৩৮৷
[10] ইসলামের ইতিহাসের ওপর লেখা যে কোন বই পাঠ করলে স্বাভাবিক ভাবে এ সত্য প্রকাশ পায়-প্রবন্ধক৷
[11] আ.এ. নিকলসনঃ এ লিটাৠারী হিস্ট্রী অব দা এরাবসঃ অনুঃ ৩, পৃঃ ৭১৷
[12] আ.এম. মুছলেহদ্দীনঃ আরবী সাহিত্যের ইতিহাসঃ পৃঃ ৩২৷
[13] মিশ্কাতুল-মাসবাবীহঃ বাবু-ফযায়ীলে সাইয়েদিল মুরসালীন, পৃঃ ৫১৭৷ “ও ‘আন জাবিরিন (রা.) আম্মান, নাবীয়্যা (সা.) কালা ইন্নাল্লাহা তা‘য়ালা বা ছানী লিতামামি মাকারিমাল আখলাকি ও কামালি মুহাসিনিল আ’মাল, রাওয়াহু ফি শাহ হিসসুন্নাহ৷”
[14] “ইন্নাকা লা’আলা খুলুকিন আজীম৷ আল-কা’লমঃ ৬৮/৩৷
[15] (ক) অধ্যাপক মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক : উচ্চতর আরবী ব্যাকরণ : পরি,৪র্থ-এর ভূমিকা, পৃ. ৩২।
[16] (খ)আল্লামাত তাহাভী : শরহে মা‘আনী আল-আছার, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৮০; করাচী সংস্করণ, ১৯৭০।
১৬ আ.এম. মুছলেহুদ্দীন : আরবী সাহিত্যের ইতিহাস : পৃ. ১৩০; আবুল ফারাজ ইস্পাহানী, কিতাবুল আগানী, খণ্ড-১৩,, পৃ. ৬৭; মুহাম্মদ আলী : দি হলি কুরআন : পৃ. 860।
১৭ আশ্শয়খ ইসমাইল হক্কী আল বরুছীঃ তাফসীবু রুহুল বয়ানঃ ১৯শ পারা, পৃঃ ৩১৭ “ও কানা আলীয়ুন (রা.) আশ্ আরার খুলাফায়ি৷”
১৮ আলীর দিওয়ান সম্মন্ধে ঐতিহাসিকদের ভিন্নমত রয়েছে, ‘আবদুল কাদীর জুরজানী বলেছেন, “আলীর (রা.) দিওয়ানের প্রথম কবিতা মুহাম্মদ-ইবন রবী আল মুস্বীলি কর্তৃক রচিত৷ আসসারুল বালাগঃ পৃঃ ২৯৪ সিয়ারু আনসারঃ ১ম খন্ডঃ পৃঃ ৩৪১, আ.এম.মুছলেহদ্দীনঃ আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, পৃঃ ১৩৩৷
১৯ ইবন-হিশামঃ সীরাতুন্নবী (সা.) খন্ডঃ -১, পৃঃ -১৭১৷
২০ ইবন-হিশামঃ সীরাতুন্নবী (সা.) খন্ডঃ -১, পৃঃ -৩৬২৷
২১ ইবন-হিশামঃ সীরাতুন্নবী (সা.) খন্ডঃ -২, পৃঃ -৩৭৪৷
২২ ইবন-হিশামঃ সীরাতুন্নবী (সা.) খন্ডঃ -২, পৃঃ -৩৬৪৷
২৩ উসদুল গা’বাঃ খন্ড-২, পৃঃ ৫৷ “ও রুওয়িয়া আন্নাল লাজিনা ইয়াহ জুনা রাসুলুল্লাহি (সা.) মিন কুরায়শিনঃ আবু সুফিয়ানুবনুল হারিছিবনি আবদিল মুত্তালিব ও আবদুল্লাহ, ঈবনযযিব আরী ও আমরুবনুল আস ও দারারুবনুল খাত্তাব”৷
২৪ আহমদ-হাসান যয়্যাত : তারীখু আদাবিল আরাবী : পৃঃ ১৫২৷ কালা লি আসহাবিহী মা ইয়ামনাউল লাজীনা নাসারুল্লাহা ও রাসুল্লাহু বি আসলিহাতি হিম আন ইয়ানসুরুহু বি আলসিনাতিহিতম? উসদুল গাবা খন্ডঃ ২ পৃঃ ৫, এতে নিম্নলিখিতভাবে উল্লেখ আছে- কালা মা ইয়ামনা উল কওমাল্লাজীনা নাসারু রাসুলাল্লাহি (সা.) বি-আস্ ইয়াফিহিম আন ইয়ানসুরুবি আলসিনাতিহিম!”
২৫ ইবনুল আসীর আ.হ.আলী মুহাম্মদ আলজযরী- উসদুল গা’বাঃ খন্ডঃ ২ পৃঃ ৬৷ “ফানতাদাবা লি হুজুয়িল মুশরিকীনা ছালাছাতুন মিনাল আনসীরিঃ হসিমান ইবনু ছাবিত ক’ব ইবনু মালিক ও আবদুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা৷”
২৬ ইবনুল আসীর আ.হু. আলী মুহাম্মদ আলজযরী- উসদুল গা’বাঃ খন্ডঃ ২ পৃঃ ৬৷ “আতাফা কানা হাসসান ও ক’ব ইয়ু আরিদানিহিম, মিছলা কওলিহিম ফিল ওকায়ি’ওল আইয়্যামি ওল মাছিরি ও ইয়াজকুরনা মিছালাহুম, ওকানা আবদুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা ইয়ু ইরুহুম বিল কুপরি ও বিইবাদাতিল মা লা ইয়াযনা’উ ওলা ইয়ানফাও৷”
২৭ আল-মিশকাতুল মাছাবীহ বাবুল-বয়ান ওয়শ্ শিরঃ পৃঃ ৪০৯৷ “ওআন আয়িশাতা (রাদিয়াল্লাহু তা’লা আনহা) কালাত কানা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ও সাল্লামা ইয়াদাউ৷ লি হাসসানা মিম্বারান ফিল মাসজিদি ইয়াকুমু আলায়হি কায়িমান ইয়ুফাখিরু আন রাসুলিল্লাহি (সা.) ইন্নাল্লাহা য়ু আ�
#সংগ্রহেঃ
নাছির বিন ইব্রাহীম
Chittagong