অভ্যাসের দাস
প্রাচীন আমলে এই বাংলা ছিল অনেক খন্ডে,
ছোট-বড় নানান অংশে বিভক্ত । ছোট খন্ডগুলি
জমিদার শাষিত ছিল আর বড় ভুখন্ডের মালিকদের
বলাহতো রাজা, মহারাজা বা বাদশাহ্ । কোন কোন
রাজা ছিলেন উৎপিড়ক – প্রজা নিস্পেষণকারী আবার
কেউ কেউ ছিলেন ন্যায়পরায়ন – প্রজাবৎসল ।
এই নিরিহ – শান্তিপ্রিয় রাজাদের মধ্যে আবার কেউ
কেউ ছিলেন শুরা-সাকি, আমোদ-প্রমোদে ব্যাস্ত আবার
কেউ ছিলেন ভাবুক- চিন্তাশিল । জ্ঞানী-গুনী,
কবি-সাহিত্যিকদে
এমনই একজন শান্তিপ্রিয় রাজা “আব্দুল্লাহ্ মাহমুদ”।
স্ত্রী, সন্তান, পরিজন নিয়ে বেশ সুখেই রাজ্য পরিচালনা
করে চলেছেন । রাজার একান্ত অনুগত মন্ত্রী “আবু জাফর”
অত্যন্ত ভাল মনের মানুষ । রাজা আব্দুল্লাহ্ প্রজা কল্যান
নিয়ে বেশ ভাবেন এবং যথাসাধ্য করতে চেষ্টা করেন ।
একদা পরন্ত বিকেল । রাজা নিজ প্রাসাদের দ্বিতলে
বিশাল উন্মুক্ত বেলকনিতে বসে বৈকালীন নাস্তা
সাড়ছেন, মন্ত্রীও যথানিয়মে রাজার সংগ দিচ্ছেন ।
ছোট্ট রাজকুমার বেলকনীতে ছুটাছুটি করচ্ছে । এমন
সময় রাজার দৃষ্টি পড়ে প্রাসাদের মূল ফটকের বাইরে
প্রধান সড়ক দিয়ে ঝাপি মাথায় একদল লোক যাচ্ছে ।
রাজাঃ- মন্ত্রী , ঐ লোকগুলো কারা ? ওরা কোথাথেকে
এসেছে আর কোথায় যাচ্ছে ?
মন্ত্রীঃ- জনাব , ওরা জেলে সম্প্রদায় । ওরা জেলে পল্লিতে
থাকে । সারারাত নদী-বিলে মাছ ধরে আর সকালে
তা বাজারে বিক্রি করে । এটাই ওদের জীবিকার
এমাত্র মাধ্যম ।
রাজাঃ- আহারে……. তাহলেতো ওদের অনেক কষ্টের জীবন,
তাই নয় কি ?
মন্ত্রীঃ- জী জনাব, যে রাতে ভাল মাছ ধরাপরে, সেদিন মাছ
বিক্রি করে ওরা দুটো পয়সা পায় । তাদিয়ে ওরা চাল
ডাল কিনে নেয় । সেদিন তাদের রান্না হয় আর বউ-বাচ্চা
নিয়ে আনন্দে খায় । আর যেদিন মাছ ধরতে পারেনা ,
সেদিন ওদের হাড়ীচড়েনা, পুরো পরিবার উপোষ থাকে ।
রাজাঃ- তাহলেতো ওদের খুবই দুঃখের জীবন, সুখ-শান্তি কেমন
ওরাতো জানেই না ।
মন্ত্রীঃ- ঠিক বলেছেন জনাব, সত্যিই ওদের জীবন খুবই দুর্বিসহ ।
ঠিকমত খাবারও জোটে না ।
সাত বছরের রাজকুমার কাছেই খেলছিল, কথাগুলো কানে যেতেই
সে এগিয়ে এলো, রাজার পাশে দাঁড়ীয়ে রাজাকে উদ্দেশ্য করে বলল
রাজকুমারঃ- বাবা , ওরা কি এতটাই গরীব, শাহী খাবার না হোক
সামান্য পোলাও-মাংশ ও কি জেটে না ওদের ?
রাজাঃ- কুমার, তুমি অনেক ছোট, এখন এগুলো বুঝতে পারবে না,
বড় হও, একদিন সব বুঝবে, এখন তুমি তোমার কাজ কর ।
মন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে……. হ্যা…. মন্ত্রী…. বলুনতো ওদের জন্য
কি করা যায় ?
মন্ত্রীঃ- মহারাজ অনেক অভিজ্ঞ……. আপনীই ভাল বুঝবেন ।
রাজাঃ- মন্ত্রী, আমি একটা চিন্তা করেছি । ওদের স্থায়ী কোন
সমাধান দিতে পারি আর নাই পারি অন্তত এক দিনের
জন্য হলেও ওদের একটু সুখ দিতে চাই । সুখ কি জিনিষ
আমি ওদের বোঝাতে চাই ।
মন্ত্রীঃ- উত্তম কথা । বলুন আমাকে কি করতে হবে ?
রাজাঃ- আপনী জেলেদলকে ফেরান । আজ ওরা আমার প্রাসাদে
শাহী মেহমান । আমি ওদেকে উত্তম মেহমানদারী করে
একদিনের জন্য হলেও সুখ দিতে চাই । ওদের সুখের
অনুভুতিটা স্বচক্ষে দেখতে চাই ।
মন্ত্রীঃ- যথা আজ্ঞা জনাব, আমি এখনই সকল ব্যবস্থা করচ্ছি ।
মন্ত্রী নিচে গিয়ে জেলে দলকে ফেরালো । রাজার নিমন্ত্রনের
কথা শুনে জেলেরা যেমন আনন্দিত তেমনই ভীত হয়ে উঠলো ।
মন্ত্রী অভয় দেয়াতে জেলেরা তাদের মাথার ঝুড়িগুলি প্রধান
ফটকের বাইরে রেখে মন্ত্রীর পিছুপিছু রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়লো ।
মন্ত্রীঃ- জনাব, জেলেদেরকে নিয়ে এসেছি ।
রাজাঃ- ওরা অত্যান্ত নোংড়া-শরীরে দুঃর্গন্ধ, ওদেরকে সুগন্ধি সাবান
দিয়ে গোসল করিয়ে উত্তম পোষাক পড়ানো হোক ।
মন্ত্রী জেলেদেরকে গোসল ও উত্তম পোষাকের ব্যবস্থা করে দিল,
গায়ে দামী সুগন্ধী মেখে দিয়ে রাজদরবারে নিয়ে এলো ।
রাজাঃ- এবার ওদেকে শাহী ভোজনশালায় নিয়ে উত্তম খাবারে
আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হোক ।
মন্ত্রীঃ- জী জনাব, আপনার নির্দেশ মত সব ব্যবস্থাই সম্পন্ন করা
আছে, আমি তাদের উত্তম আপ্যায়নের ব্যবস্থা করচ্ছি ।
মন্ত্রী জেলেদেরকে উত্তম খাবারে আপ্যায়ন করলেন আর রাজা
তার জিজ্ঞাসু মন নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন যে জেলেরা
উত্তম-সুস্বাদু খাবার পেয়ে কতটা উৎফুল্ল হয় । রাজা তাদের মন
পড়তে চেষ্টা করছেন। অভুক্ত জেলেরা গোগ্রাসে খেয়ে নিলো
সব খাবার । এর পর রাজার হুকুমে তাদেরকে শাহী বিশ্রামাগারে
নেয়া হল । দামী পালঙ্ক, মখমলের নরম বিছানা । অতিরিক্ত
ভোজনে সকলেই ক্লান্ত, রাতও হয়েছে অনেক, সবাই আনন্দ
করে বিছানায় গেল কিন্তু একটু পরেই সবাই উঠে বসলো ।
রাজা লুকিয়ে সব দেখছেন, তিনি দেখতে চান এই একদিনের
বিলাসি জীবনে তারা কতটুকু খুশি হয়, তাদের আনন্দানুভুতিটা
কেমন হয় । কেউ ঘুমাচ্ছে না, ফিস ফিস কথা বলচ্ছে আর
কোমড় থেকে বটপাতার বিড়ি বেড় করে ফুঁকচ্ছে । এবার মন্ত্রী
রেগে গেল, ওদের বাধাদিতে উদ্যত হতেই রাজা তাকে থামালেন ।
রাজাঃ- থাক মন্ত্রী, ওরা এক দিনের মেহমান, যা খুশি করতে দিন ।
মন্ত্রীঃ- জনাব , ওরা সবকিছু নষ্ট করে ফেলবে যে ।
রাজাঃ- করুক…… সব কিছুর বিনিময়ে আমি ওদের সুখানুভুতিটা
স্বচক্ষে দেখতে চাই ।
বিড়ি ফুঁকা শেষ করে জেলেরা শুয়ে পড়লো কিন্তু শুধুই
এপাশ-ওপাশ, ঘুম আর আসচ্ছে না ।
রাজাঃ- মন্ত্রী , ওরা ঘুমাচ্ছে না কেন ? নিজ বাড়ীতে কি ওরা এরচেয়ে
ভাল স্থানে থাকে ?
মন্ত্রীঃ- জনাব কি যে বলেন, এটা ওরা কখনও স্বপ্নেও দেখে না ।
রাজাঃ- তাহলে সমস্যাটা কি ? ঘুমাচ্ছে না কেন ?
মন্ত্রীঃ- জনাব আমিও সেটাই ভাবচ্ছি ।
রাজাঃ- তাহলে কি ওরা সুখি নয় ?
মন্ত্রীঃ- নিশ্চয়ই সুখি তবে একটু অপেক্ষা করুন, আমি ওদের
অস্বস্থির কারনটা খুজে বের করার চেষ্টা করচ্ছি ।
মন্ত্রী ওদেকে দেখচ্ছে………. পায়চারী করচ্ছে আর ভাবচ্ছে,
আসলে সমস্যাটা কোথায় । হঠাৎ মন্ত্রী কিছু একটা মনে পড়ায়
দুজন পেয়াদা সংগে নিয়ে প্রধান ফটকের কাছে গেলেন এবং
পেয়াদাদের নির্দেশ করলেন মাছের ঝুড়িগুলি নিয়ে জেলেদের
কক্ষের এক কোনে রাখতে । পেয়াদারা সেটাই করলো । এবার
মন্ত্রী রাজাকে সংগে নিয়ে ঐ কক্ষের সামনে গেলেন । ততক্ষনে
মৃদু বাতাসে ঝুড়ির মাছপচা গন্ধ সারা ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে
আর জেলেরা আরামে নাকডেকে ঘুমাচ্ছে । রাজা হতবাক ।
রাজাঃ- মন্ত্রী, এটা কেমন হোল ?
মন্ত্রীঃ- জনাব আমি ভেবে দেখলাম, এই মাছপচা গন্ধের সংগে
ওদের জীবন ওৎপ্রোতভাবে জরিত । সার্বক্ষণিক এই গন্ধেই ওরা
অভ্যস্ত তাই ভাবলাম প্রাসাদের এই কক্ষে এতকিছুর মধ্যে ঐ
চির পরিচিত গন্ধটারই অভাব ওরা অনুভব করচ্ছিল। আর দেখুন
সেই গন্ধটা পেতেই কেমন সুখনিদ্রায় তলিয়ে গেল ।
রাজার পর্যবেক্ষন শেষ । পরের দিন প্রত্যুষে জেলেদেরকে কিছু
উপঢৌকন দিয়ে বিদায় করা হোল । ফিরে গেল তারা তাদের
চিরচেনা আপন ভুবনে….. তাদের অভয়ারণ্যে ।।
মর্মকথাঃ- মানুষ অভ্যাসের দাস । যে যে বলয়ে অবস্থান করে
সেটাই হয়ে উঠে তার আপন পরিবেশ । মন-মনন , চিন্তা-চেতনা
এমনকি ইন্দ্রিয়গুলিও সেই পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে পরে । সেই
অবস্থান থেকে বের হয়ে আসা যেমন কঠিন তেমনই সময়সাপেক্ষ ।।
সমাপ্ত…………….
আজম খান ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন