অনামিকার ভাবনা
মোনোয়ার হোসেন
--------------------------
চমৎকার সকাল !
আজ শেষ রাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে । সেই বৃষ্টির পানির ফোঁটা এখনো ভোরের শিশিরের মত গাছের পাতায় ,মাঠের সবুজ ঘাসে জমে আছে ।
অনামিকা শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করল।এটা তার চিরাচয়িত অভ্যাস । কোন ভাল কাজ করার অাগে সে দু’রাকাত নফল নামাজ অাদায় করে । অনামিকার মা খুব ভাল মা । অাদর্শ মা । বর্তমান যুগে ডিজিটাল অার অাধুনিক নামে ছেলে মেয়েরা নিজেকে যে নোংরামী পর্যায়ে নিয়ে এসেছে তার ছিঁটে ফোঁটাও পরেনি অনামিকার উপর । অার্দশ মা তাকে গড়ে তুলেছেন একান্ত নিজের মত করে । নবী [সা:] এর দেখানো পথে । ফলে অনামিকা বেড়ে উঠে সম্পূর্ণ এক ইসলামী পরিবেশে । কোন ভাল কাজ করার পূর্বে সে দুরাকাত নফল নামাজ অাদায় করে অাল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে নেয় তারপর কাজটি শুরু করে । অাজ সকাল ৯টায় তারা স্কুল থেকে শিক্ষা সফরে যাবে ,তাই অনামিকা ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে অাল্লাহর কাছে পথের সকল অাপদ বিপদ হতে সাহায্য চেয়ে নিল । বলল , হে অাল্লাহ ! পথের সকল অাপদ বিপদ হতে অামি তোমার কাছে সাহায্য প্রার্থণা করছি , এবং শয়তানের ওয়াস ওয়াসা হতে তোমার কাছে অাশ্রয় প্রার্থনা করছি । মা বলেছেন , শোন অনামিকা , তাহাজ্জুদ নামাজের খুব ফজিলত । কেউ যদি শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ অাদায় করে খাঁটি দিলে অাল্লাহর কাছে কিছু চায় অাল্লাহ তায়ালা তাকে খালি হাতে ফেরিয়ে দেয় না । অাল্লাহ তায়ালা প্রতিদিন শেষ রাতে পৃথিবীর অাসমানে এসে ঘোষণা করেন , কে অাছে সাহায্যকরী ? অামার কাছে চাও , অামি তোমাকে সাহায্য করব । অনামিকা মাকে খুব ভালোবাসে । মা তাকে যে কথা বলে সে তা অাগ্রহ ভরে শোনে । পালন করে । পালন করার চেষ্টা করে । কারণ সে মনে করে তার মা তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা । শ্রেষ্ঠ শিক্ষক । অার্দশ মা ।
অনামিকা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার পর সেই নামাজের মাদুলিতে বসে কিছুক্ষণ অাল্লাহর নামে তাশবীহ্ পড়ল ,অত:পর নিজের পাঠ্য বইয়ে চোখ বুলাল । ফজরের অাজান হলে ফজরের নামাজ পড়ে জানালার পাশে বসে কোরঅান তেলোয়াত করল । কোরঅান তেলোয়াত শেষে জানালা বেয়ে বাহিরে তাকাল । শীতের সকালের নরম সোনালী রদ্দুর এসে পড়েছে ভেজা ঘাস ও ভেজা পাতার উপর । নরম রোদে ভেজা ঘাস ও ভেজা পাতা যেন চারদিকে মুক্তা ঝরাচ্ছে । প্রকৃতির এই অপরুপ সৌন্দর্যের লিলাখেলা দেখে অনামিকার কিশোরী মন অানান্দে দুলে উঠে । মনে এক অজানা ভাল লাগা খেলা করে । মনের অজান্তই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে “ আলহামদুলিল্লাহ ”।
সকাল ৭ টায় শিক্ষা সফরের যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করে অনামিকা মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় । হাসি মুখে মা, দাদা,দাদীর কাছে বিদায় নিয়ে সালাম বিনিময় কর অাল্লাহর নাম নিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয় ।
[ দুই ]
স্কুলের সামনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে অাছে পিকনিকে যাওয়া মাইক্রোবাসগুলি । স্ব-স্ব সীটে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছে স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রী । কিছুক্ষণের মধ্যে মাক্রোগুলি ছাড়বে তাদের গন্তব্যের দিকে । পটুয়াখালী কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের দিকে । এতদিন তারা শুনে এসেছে পটুয়াখালী সমুদ্রে সৈকতে সূর্য উদয় ও অস্ত যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করা যায় , অাজ তারা স্বচোখে দেখবে এ কথা ভাবতে সবার মনের ভিতরে এক অন্য রকম ভালো লাগা খেলা করে । সবার মুখে ফুটে উঠে রাজ্য জয়ের হাসি ।
অনামিকা যে গাড়িতে বসে অাছে সে গাড়ির জানালায় কে যেন ঠকঠক করে ধাক্কা মারে । অনামিকা ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকায় । দেখে ৭-৮ বছর বয়সি একটি মেয়ে হাতে ফুল নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অাছে ।
অনামিকা জানালা খুলে মিষ্টি হেসে প্রশ্ন করে, কিছু বলবে বোন ?
মেম সাব ফুল নিবেন ?
ওমা! তোমার ফুল তো খুব সুন্দর !
[ মেয়েটি মলিন মুখে হাসির রেখা তুলে ]
কত করে বিক্রি করো ফুল ?
৫ টাকা , মেম সাব ।
বেশ , অামাকে দুটো দাও ।
দুটো ফুল নিয়ে অনামিকা মেয়েটিকে ৫০ টাকার একটা নোট দিয়ে বলল, এটা রাখ ,অামাকে অার ফেরত দিতে হবে না ।
মুখে মিষ্টি হাসির রেখা তুলে মেয়েটি বলল, অাফনে খুব ভালা মেম সাব ।
মেকি হেসে অনামিকা বলল, তুমিও খুব ভাল।
তারপর একটু থেমে বলল, কি নাম তোমার ?
পাপড়ি ।
বাহ ! খুব সুন্দর নাম তো তোমার !
মেয়েটি কোন কথা বলে না । মাথা নিঁচু করে । মাথা নিঁচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে হাসে । মনে হয় অনামিকার কথায় বেশ লজ্জা পেয়েছে সে।
অনামিকা অাবার বলে, তুমি ফুল বিক্রি কর কেন ? স্কুলে যাওনা ?
মেয়েটি বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে , হু গরীবের অাবার লেহা পড়া!
কেন ? তোমার বাবা মা নেই ?
মা অাছে । অসুস্থ । বিছানায় পড়ে অাছে । বাবা নাই । একটা মাইয়্যা লইয়া ভাগছে ।
কও কি?
হাছা কইছি । এই ফুল বেঁচে মার লগে ঔষুধ লয়ে যামু ।
মায়ের প্রতি মেয়েটির গভীর ভালোবাসা দেখে অনামিকার চোখে পানি চলে অাসে । চোখের কণা চিক চিক করে উঠে । মেয়েটিকে বলে পাপড়ি তুমি প্রতিদিন অামার স্কুলের সামনে অাসবে অামি তোমার কাছে প্রতিদিন ফুল কিনবো ।
অনামিকার গাড়ি দুলে উঠে । গাড়ি ছাড়ে পুটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে ।
[ তিন ]
শিক্ষা সফরে সহপাঠীদের সাথে ভালই মজা করল অনামিকা । কাছ থেকে দেখল সমুদ্রে সূর্য উঠা এবং ডুবার দৃশ্য । দেখে মুগ্ধ হলো । মুগ্ধ হয়ে মনে মনে অাল্লাহর শুকুরিয়া অাদায় করল ।
গভীর রাতে বাসায় ফিরে ক্লান্ত দেহ বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
সকালে স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক মাথা ঘুড়িয়ে পাপড়িকে খুঁজতে লাগল ।
পিছন থেকে পাপড়ি এসে এক গাল হেসে বলল, কেমন অাছেন মেম সাব ?
জ্বী ভাল । তুমি কেমন অাছো ?
ভালা অাছি ।
তোমার মা কেমন অাছে ?
অাজ একটু ভালা মেম সাব । তারপর একটু থেমে বলল, মেম সাব , অাইজ অাফনের লগে সবচেয়ে ভালা গোলাপ দুইটি বাইছা রাখছি । অাফনে খুব ভালা তো তাই সবচেয়ে ভালা গোলাপ অাফনার ।
হেসে ফুল নিয়ে ৫০ টাকা পাপড়িকে দিয়ে অনামিকা বলল, এটা রাখ অার ফেরত দিতে হবে না । তোমার অাম্মার জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে যাবে ।
এ ভাবে প্রতদিন পাপড়ির কাছ থেকে দুইটা করে গোলাপ কিনে ৫০ টাকা করে দিতো অনামিকা ।
[ চার ]
চার দিন হল পাপড়ি অার স্কুলের গেটে ফুল বিক্রি করতে অাসে না । অনামিকা অনেক্ষণ পাপড়ির জন্য গেটে দাঁড়িয়ে থাকে । কিন্তু পাপড়ি অাসে না । পাপড়িকে না পেয়ে অনেকটা অাহত মনে ক্লাসে প্রবেশ করে অনামিকা ।
ইস্কুল থেকে বাসায় ফিরে অাজ পাপড়ির কথা কেন যেন খুব মনে পড়ছে তার ।
মাকে বলে, মা, চলো তো একটু বাইরে যায় ।
কথায় যাবে মা?
চলো না, গেলেই বুঝতে পারবে ।
মা জানে অনামিকা খুবেই শান্ত মেয়ে । কোন কিছুর প্রতি চাহিদা নেই তার , কোন কিছুর প্রতি লোভ লালসা নেই , বাবা যেটা এনে দেয় সেটা নিয়ে খুশী থাকে সে। কখনও কখনও বলে, এটা নিয়ে অাসার কি প্রয়োজন ছিল বাবা ? অামার তো অনেক জামা অাছে । শুধু শুধু অপচয় করে কি লাভ বলো ? বাবা হেসে বলেন , দেখ মেয়ের কান্ড !
মা বলেন , এনেছে যখন নিয়ে নে মা! অাগেরগুলো তো বেশ পুরনো হয়ে গেছে ।
কোথাও বেড়াতে যেতে বললে বলে, তুমি যাও মা! বাইরে যেতে অামার ভাল লাগেনা ।
এই মেয়ে অাজ নিজ থেকে বাইরে যেতে চাচ্ছে নিশ্চয় তার কোন জরুরী কাজ অাছে । মা অার কোন অজুজাত না তুলে মেয়ের সঙ্গে বের হয় ।
অনামিকা মাকে নিয়ে যায় খিলগাঁও রেল কলোনী বস্তিতে ।
মা বলেন , এই বস্তিতে তুমি কোথায় অামাকে নিয়ে যাচ্ছ মা?
অামার সাথে এসো মা, সব বুঝতে পারবে ।
কি জানি বাপু অামি কিছুই বুঝতে পারি না । বলে মেয়েকে অনুসরণ করে হাঁটতে থাকেন মা ।
বস্তির শেষ প্রান্তে গিয়ে খুঁজে পায় পাপড়িকে ।
ছোট একটি ঘর, ঘর তো নয় যেন মুরগীর খোপড়ি। প্লাসটিকের বেড়া , উপড়ে মরিচীকা ধরা দুটো টিন ফেলে দেয়া অাছে । ঘরে ঢুকে দাঁড়ানো যায়না । বসে বসে ঘরে ঢুকতে হয় ।
অনামিকাকে দেখে খোপড়ি থেকে বের হয় পাপড়ি ।
চোখদুটি ফোলা ফোলা , লাল । দেখে মনে হয় অনেক কেঁদেছে ।
পাপড়িকে দেখে অনামিকার ভিতরটা কেমন যেন মোচর দিয়ে উঠে ।
কোন মতে বলে, কেমন অাছ পাপড়ি ?
তুমি অার ফুল বিক্রি করতে অাস না কেন ?
অার ফুল বেচতে হবেনা মেম সাহেব ।
কেন ?
যার জন্য ফুল বেচি হে অামার মা অার নেই ।
অনামিকার মনটা টনটন করে উঠে । নেই মানে ?
মারা গেছে । অামার মা মারা গেছে । তিন দিন হল মা মারা গেছে । বলে ডুকরে কেঁদে উঠে পাপড়ি ।
পাপড়ির কান্না দেখে অনামিকার চোখ ভিজে অাসে । পাপড়ির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে কেঁদো না বোন ,অামি অাছি তোমার পাশে ।
এমন সময় পাশে কোন এক খোপড়ি থেকে খকখক কাশির শব্দ ভেসে অাসে , মনে হয় অার এক মৃত্যুর পথযাত্রী মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে !
তার পরের কোন এক খোপড়ি থেকে এক অভাগী বৃদ্ধার করুন কন্ঠস্বর ভেসে অাসে , হায় অাল্লাহ ! অার পারছিনা ,তুই অামাকে নিয়ে যা !
বস্তির চারদিকের পরিবেশ দেখে অনামিকা কেমন যেন উদ্বেলিত হয়ে উঠে । তার কচি মন ব্যথায় কুকঁড়ে উঠে ।
সে মাকে জড়িয়ে ধরে । জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে । দেখছো মা, অসহায় মানুষের অাহাজারী !
একটু থেমে চোখের পানি মুছে অনামিকা, চোয়াল শক্ত করে । বলে, মা, অামি ডাক্তার হব । বড় হয়ে অামি ডাক্তার হব । এই অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াব । তাদের ফ্রী চিকিৎসা দেব ।
মেয়ের কথা শোনে গৌরবে বুক ভরে উঠে মায়ের ।
মেয়ের চোয়াল ধরে বলে, তুমি তাই হবে মা!