ঘুম ভাঙল। ঘুমের ঘোর তবু ভাঙল না। … নিশি আমার ভোর হলে, সে স্বপ্নও ভাঙল,
আর তার সঙ্গে ভাঙল আমার বুক! কিন্তু এই যে তার শাশ্বত চিরন্তন স্মৃতি, তার
আর ইতি নেই। না – না, মরুর বুকে ক্ষীণ একটু ঝরনা-ধারার মতো এই অম্লান
স্মৃতিটুকুই তো রেখেছে আমার শূন্য বক্ষ স্নিগ্ধ-সান্ত্বনায় ভরে। বয়ে যাও
ওগো আমার ঊষর মরুর ঝরনা-ধারা, বয়ে যাও এমনি করে বিশাল সে এক তপ্ত শূন্যতায়
তোমার দীঘল রেখার শ্যামলতার স্নিগ্ধ ছায়া রেখে। দুর্বল তোমার এই পূত
ধারাটিই বাঁচিয়ে রেখেছে বিরাট কোনো এক মরুভূ-প্রান্তরকে, তা তুমি নিজেও জান
না, – তবু বয়ে যাও ওগো ক্ষীণতোয়া নির্ঝরিণীর নির্মল ধারা, বয়ে যাও।
নিশি-ভোরটা নাকি বিশ্ববাসী সবার কাছেই মধুর, তাই এ-সময়কার টোড়ি রাগিণীর
কল-উচ্ছ্বাসে জাগ্রত নিখিল অখিলের পবিত্র আনন্দ-সরসী-সলিলে ক্রীড়ারত
মরালযূথের মতো যেন সঞ্চরণ করে বেড়ায়, কিন্তু আমার নিশি ভোর না হলেই ছিল
ভালো। এ আলো আমি আর সইতে পারছি নে, – এ যে আমার চোখ ঝলসিয়ে দিলে! এ কী
অকল্যাণময় প্রভাত আমার!
ভোর হল। বনে বনে বিহগের ব্যাকুল কূজন বনান্তরে গিয়ে তার প্রতিধ্বনির রেশ
রেখে এল! সবুজ শাখীর শাখায় শাখায় পাতার কোলে ফুল ফুটল। মলয় এল বুলবুলির
সাথে শিস দিতে দিতে। ভ্রমর এল পরিমল আর পরাগ মেখে শ্যামার গজল গানের সাথে
হাওয়ার দাদরা তালের তালে তালে নাচতে নাচতে। কোয়েল, দোয়েল, পাপিয়া সব মিলে
সমস্বরে গান ধরলে, –
ওহে সুন্দর মরি মরি!
তোমায় কী দিয়ে বরণ করি!
অচিন কার কণ্ঠ-ভরা ভৈরবীর মিড় মোচড় খেয়ে উঠল – ‘জাগো পুরবাসী।’ সুষুপ্ত বিশ্ব গা মোড়া দিয়ে তারই জাগরণের সাড়া দিলে!
তুমি সুন্দর, তাই নিখিল বিশ্ব সুন্দর শোভাময়।
পড়ে রইলুম কেবল আমি উদাস আনমনে, আমার এই অবসাদ-ভরা বিষণ্ণ দেহ ধরার বুকে
নিতান্ত সংকুচিত গোপন করে, হাস্যমুখরা তরল উষার গালের একটেরে এককণা অশুষ্ক
অশ্রুর মতো! অথচ এই যে এক বিন্দু অশ্রুর খবর, তা উষা-বালা নিজেই জানে না,
গত নিশি খোওয়াবের খামখেয়ালিতে কখন সে কার বিচ্ছেদ-ব্যথা কল্পনা করে
কেঁদেছে, আর তারই এক রতি স্মৃতি তার পাণ্ডুর কপোলে পূত ম্লানিমার ঈষৎ আঁচড়
কেটে রেখেছে।
ঘুমের ঘোর টুটলেই শোর ওঠে, –ওই গো ভোর হল! জোর বাতাসে সেই কথাই নিভৃত-সব
কিছুর কানে কানে গুঞ্জরিত হয়। সবাই জাগে – ওঠে – কাজে লাগে। আমার কিন্তু
ঘুমের ঘোর টুটেও উঠতে ইচ্ছে করছে না। এখনও আপশোশের আঁসু আমার বইছে আর বইছে।
সব দোরই খুলল, কিন্তু এ উপুড়-করা গোরের দোর খুলবে কী করে? – না, তা খোলাও
অন্যায়, কারণ এ গোরের বুকে আছে শুধু গোরভরা কঙ্কাল আর বুকভরা বেদনা, যা
শুধু গোরের বুকেই থেকেছে আর থাকবে! – দাও ভাই, তাকে পড়ে থাকতে দাও এমনি
নীরবে মাটি কামড়ে, আর ওই পথ বেয়ে যেতে যেতে যদি ব্যথা পাও, তবে শুধু একটু
দীর্ঘশ্বাস ফেলো, আর কিচ্ছু না!
* * *
আচ্ছা, আমি এই যে আমার কথাগুলো লিখে রাখছি সবাইকে লুকিয়ে, এ কি আমার ভালো
হচ্ছে? নাঃ, তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি নে, – এ ভালো, না মন্দ। হাঁ,
আর এই যে আমার লেখার উপর কুয়াশার মতো তরল একটা আবরণ রেখে যাচ্ছি, এটাও
ইচ্ছায়, না অনিচ্ছায়? তাই বলছি, এখন যেমন আমি অনেকেরই কাছে আশ্চর্য একটা
প্রহেলিকা, আমি চাই চিরটা দিনই এমনি করে নিজেকে লুকিয়ে থাকতে – আমার
সত্যিকারের ব্যথার উৎসে পাথর চাপা দিয়ে আর তারই চারি পাশে আবছায়ার জাল বুনে
ছাপিয়ে থাকতে, বুকের বেদনা আমার গানের মুখর কলতানে ডুবিয়ে দিতে। –কেননা,
যখন লোকে ভাববে আর হাসবে, যে, ছি! – সৈনিকেরও এমন একটা দুর্বলতা থাকতে পারে
! না না – এখন থেকে আমার বুক সে চিন্তাটার লজ্জায় ভরে উঠছে! – আমার এই
ছোটো কথা ক-টি যদি এমনই এক করুণ আবছায়ার অন্তরালেই রেখে যাই, তাহলে হয়তো
কারুর তা বুঝবার মাথা-ব্যথা হবে না। আর কোনো অকেজো লোক তা বুঝবার চেষ্টা
করলেও আমায় তেমন দূষতে পারবে না। দূর ছাই, যতসব সৃষ্টিছাড়া চিন্তা। কারই বা
গরজ পড়েছে আমার এ লেখা দেখবার? তবু যে লিখছি? মানুষ মাত্রেই চায় তার
বেদনায় সহানুভূতি, তা নইলে তার জীবনভরা ব্যথার ভার নেহাৎ অসহ্য হয়ে পড়ে যে।
দরদি বন্ধুর কাছে তার দুখের কথা কয়ে আর তার একটু সজল সহানুভূতি আকর্ষণ করে
যেন তার ভারাক্রান্ত হৃদয় অনেকটা লঘু হয়। তাছাড়া, যতই চেষ্টা করুক,
আগ্নেয়গিরি তার বুক-ভরা আগুনের তরঙ্গ যখন নিতান্ত সামলাতে না পেরে ফুঁপিয়ে
ওঠে, তখন কী অত বড়ো শক্ত পাথরের পাহাড়ও তা চাপা দিয়ে আটকে রাখতে পারে? কখনই
না। বরং সেটা আটকাতে যাবার প্রাণপণ আয়াসের দরুন পাহাড়ের বুকের
পাষাণ-শিলাকে চুর-মার করে উড়িয়ে দিয়ে আগুনের যে হলকা ছোটে, সে দুর্নিবার
স্রোতকে থামায় কে?… হাঁ, তবু ভাববার বিষয় যে, সে দুর্মদ দুর্বার
বাষ্পোচ্ছ্বাসটা আগ্নেয়গিরির বুক থেকে নির্গম হয়ে যাবার পরই সে কেমন
নিস্পন্দ শান্ত হয়ে পড়ে। তখন তাকে দেখলে বোধ হয়, মৌন এই পাষাণ-স্তূপের যেন
বিশ্বের কারুর কাছে কারুর বিরুদ্ধে কিছু বলবার কইবার নেই। শুধু এক পাহাড়
ধীর প্রশান্ত-নির্বিকার শান্তি! আঃ – সেই বেশ!
আচ্ছা, বাইরে আমি এতটা নিষ্করুণ নির্মম হলেও আমার যে এই মরু-ময়দানের শুকনো
বালির নীচে ফল্গুধারার মতো অন্তরের বেদনা, তার জন্যে করুণায় একটি আঁখিও কি
সিক্ত হয় না? এতই অভিশপ্ত বিড়ম্বিত জীবন আমার! হয়তো থাকতেও পারে। তবু চাই
নে যে? – না ভাই, না, প্রত্যাখ্যান আর বিদ্রুপের ভয় ও বেদনা যে বড়ো
নিদারুণ! তাই আমার অন্তরের ব্যথাকে আর লজ্জাতুর করতে চাই নে – চাই নে। হয়তো
তাতে সে কোন্ এক পবিত্র স্মৃতির অবমাননা করা হবে। সে তো আমি সইতে পারব না।
– অথচ একটু সান্ত্বনা যেন এ নিরাশ নীরস জীবনে খুবই কামনার জিনিস হয়ে
পড়েছে। এখন আমার সান্ত্বনা হচ্ছে এই লিখেই – এমনি করে আমার এই গোপন খাতাটির
সাদা বুকে তারই – সেই বেদনাতুর মূর্তিটিরই প্রতিচ্ছবি আবছায়ায় এঁকে। আমার
সাদা খাতার এই কালো কথাগুলি আর গানের স্নিগ্ধ-কল্লোল এই দুটি জিনিসই আমার
আগুন-ভরা জীবনে সান্ত্বনা-ক্ষীর ঢেলে দিচ্ছে আর দেবে!…
আমার আজ দুনিয়ার কারুর উপর অভিমান নেই! আমার সমস্ত মান-অভিমান এখন তোমারই
উপর খোদা! তুমিই তো আমায় এমন করে রিক্ত করেছ, তুমিই যে আমার সমস্ত স্নেহের
আশ্রয়কে ঝড়ো-হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সারা বিশ্বকে আমার ঘর করে তুলছ, – এখন পর
হলে চলবে না – এড়িয়ে যেতেও পারবে না। এখন তুমি না সইলে এ দুরন্তের আবদার
অত্যাচার কে সইবে বল? ওগো আমার দুর্জ্ঞেয় মঙ্গলময় প্রভু, এখন তুমিই আমার
সব! –
* * *
হাঁ, এখনই লিখে থুই, নইলে কে জানে কোন্ দিন দুশমনের শেলের একটা তীব্র আঘাত
ক্ষণিকের জন্যে বুকে অনুভব করে চিরদিনের মতো নিথর-নিঝুম হয়ে পড়ব! এই
মহাসমরসাগরে ছোট্ট এক বুদ্বুদের মতোই মাথা তুলে উঠেছি, আবার হয়তো এক পলকেই
আমার ক্ষুদ্র বুকের সমস্ত আশা-উৎসাহ ব্যথা-বেদনা থেমে গিয়ে ওই বুদ্বুদটির
মতোই কোথায় মিলিয়ে যাব। কেউ আহা বলবে না – কেউ উহুঁ করবে না! আমার কাছে
সেই মৃত্যুর চিন্তাটা কেমন একরকম প্রশান্ত মধুর!
আর একটা কথা, – আমাকে কিন্তু বাইরে এখনকার মতোই এমনই রণদুর্মদ, কর্তব্যের
সময় এমনই মায়া-মমতাহীন ক্রূর সেনানী, যুদ্ধে সমুদ্রের উচ্ছ্বাসের চেয়েও
দুর্বিনীত দুর্বার নররক্তপিপাসু দুর্বৃত্ত দানবের মতোই থাকতে হবে। কলের
মানুষের মতো আমার অধীন সৈনিকগণ যেন আমার হুকুম মানতে শেখে। আমার
দায়িত্বজ্ঞানে আমার কাজে কলঙ্ক বা শৈথিল্যের যেন এতটুকু আঁচড় না পড়ে।
সৈনিকের যে এর বড়ো বদনাম নেই। – তার পর কর্তব্য-অবসানেই আমি তাদের সেই
চিরহাস্য প্রফুল্ল গীতিমুখর স্নেহময় ভাই! তখন আমার এই অগ্নি-উদ্গারী নয়নেই
যেন স্নেহের সুরধুনী ক্ষরে, বজ্রনির্ঘোষের মতো এই কাঠচোটা স্বরেই যেন
করুণা আর স্নেহ ক্ষীর হয়ে ঝরে, আমার কণ্ঠভরা গানে তাদের চিত্তের সব গ্লানি
দূর হয়ে যায়! আমার অন্তর আর বাহির যেন এমন একটা অস্বচ্ছ আবরণে চির-আবৃত
থাকে যে, কেউ আমার সত্যিকার কান্নারত মূর্তিটি দেখতে না পায়, হাজার
চেষ্টাতেও না!
খোদা, আমার অন্তরের এই উচ্ছ্বসিত তপ্তশ্বাস যেন আনন্দ-পুরবির মুখরতানে
চিরদিনই এমনই ঢাকা পড়ে যায়, শুধু এইটুকুই এখন তোমার কাছে চাইবার আছে। আর
যদি এই অজানার অচিন ব্যথায় কোনো অবুঝ হিয়া ব্যথিয়ে ওঠে, তবে সে যেন মনে মনে
আমার প্রার্থনায় যোগ দিয়ে বলে, – ‘আহা, তাই হোক!’ কেননা এমনিতর
স্নেহ-কাঙাল, যারা, – যাদের মৃত্যুতে এক ফোঁটা আঁসু ফেলবারও কেউ নেই এ
দুনিয়ায়, যারা কারুর দয়া চায় না, অথচ এক বিন্দু স্নেহ-সহানুভূতির জন্যে
উদ্বেগ-উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকে, – তাদের দেওয়ার এর বেশি কিছু নেই, আর থাকলেও
তারা তা চায়ও না। এই একটু স্নিগ্ধ বাণীই গুহার ম্লান বুকে জ্যোৎস্নার
শুভ্র আলোর মতো তাদের সান্ত্বনা দেয়।
* * *
সে ছিল এমনই এক চাঁদনী-চর্চিত যামিনী, যাতে আপনি দয়িতের কথা মনে হয়ে
মর্মতলে দরদের সৃষ্টি করে! মদির খোশ-বুর মাদকতায় মল্লিকা-মালতীর মঞ্জুল
মঞ্জরিমালা মলয় মারুতকে মাতিয়ে তুলেছিল। উগ্র রজনিগন্ধার উদাস সুবাস
অব্যক্ত অজানা একটা শোক-শঙ্কায় বক্ষ ভরে তুলেছিল। … সে এল মঞ্জীর-মুখর-চরণে
সেই মুকুলিত লতাবিতানে! তার বাম করে ছিল চয়িত ফুলের ঝাঁপি। কবরী-ভ্রষ্ট
আমের মঞ্জরি শিথিল হয়ে তারই বুকে ঝরে ঝরে পড়ছিল, ঠিক পুষ্প-পাপড়ি বেয়ে
পরিমল ঝরার মতো। কপোল-চুম্বিত তার চূর্ণকুন্তল হতে বিক্ষিপ্ত কেশর-রেণুর
গন্ধ লুটে নিয়ে লালস-অলস ক্লান্ত সমীর এরই খোশ খবর চারিদিকে রটিয়ে এল, –
ওগো ওঠো, দেখো ঘুমের দেশ পেরিয়ে স্বপ্ন-বধূ এসেছে!’ উল্লাস-হিল্লোলে শাখায়
শাখায় ঘুমন্ত ফুল দোল খেয়ে উঠল! আমার কপালে ঘাম ভরে উঠল, বক্ষ দুরু দুরু
করে কাঁপিয়ে গেল সে কোন্ বিবশ শঙ্কা। ঘন ঘন শ্বাস পড়ে আমার হাতের
কামিনী-গুচ্ছটির দলগুলি খসে খসে পড়তে লাগল। আমার বোধ হল, এ কোন্ ঘুমের
দেশের রাজকন্যা আমার কিশোরী মানস-প্রতিমার পূর্ণ পরিণতির রূপে এসে আমার
চোখে স্বপ্নের জাল বুনে দিচ্ছে! ভয়ে ভয়ে আমার আবিষ্ট চোখের পাতা তুলেই
দেখতে পেলুম, বেতস লতার মতো সে আমার সামনে অবনত মুখে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। আমাকে
চোখ মেলে চাইতে দেখে যেন সে চলে যেতে চাইল। আমি তাড়াতাড়ি ভীত জড়িত স্বরে
বললুম, – ‘কে তুমি – পরি?’
তার আয়ত আঁখির এক অনিমিখ চাউনি দিয়ে আমার পানে চেয়েই সে থমকে দাঁড়াল! শুক্ল
জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখতে পেলুম, তার দুটি বড়ো বড়ো চোখে চোখ-ভরা জল! … এক
পলকে পরির নূপূরের রুনু-ঝুনু শিঞ্জিনী চমকে যেন কী বলে উঠল। আনন্দ-ছন্দের
হিন্দোলার দোল আর দুলল না! অসম্বৃতা তার লুণ্ঠিত চঞ্চল অঞ্চল সম্বৃত হল।
শিথিলবসনার ফুল্ল কপোলে লাজ-শোণিমা বিদীর্ণপ্রায় দাড়িম্বের মতো হিঙ্গুল হয়ে
ফুটল। সমীরের থামার সাথে সাথে যেন উলসিত-সরসী-সলিলের কল-কল্লোল নিথর হয়ে
থামল, আর তারই বুকে এক রাস পাতার কোলে দুটি রক্ত-পদ্ম ফুটে উঠল। ত্রস্তা
কুরঙ্গীর মতো ভীতি তার নলিন-নয়নে করুণার সঞ্চার করলে। বারবার সংযত হয়ে
ক্ষীণকণ্ঠে সে কইলে, – ‘তুমি – আপনি কখন এলেন? –’
আমি বললুম, – ‘আজ এসেছি। তুমি বেশ ভালো আছ পরি?’
সে একটু ক্লিষ্ট হাসি হেসে কইলে, ‘হ্যাঁ, আজ এখানে মা আর আমাদের বাড়ির সকলে
বেড়াতে এসেছেন। এ বাগানটা ভাইজান নতুন করে করলেন কিনা! – ওই যে তাঁরা
পুকুরটার পাড়ে বসে গল্প করছেন।’
আমার নেশা যেন অনেকটা কেটে গেল। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে বললুম, ‘ওঃ, আজ প্রায়
দু-বছর পরে আমাদের দেখা, নয় পরি? তোমাকে যেন একটু রোগা-রোগা দেখাচ্ছে, কোনো
অসুখ করেনি তো?’
সে তার ব্যথিত দুটি আঁখির আর্ত দৃষ্টি দিয়ে আমার পানে অনেকক্ষণ চেয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বললে, ‘– না! –’
তারপরেই যেন তার কী কথা মনে পড়ে গেল। সে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কয়ে উঠল, ‘আপনি!
এখানে কেন আর? যান!…’ এক নিমেষে এমন আকাশভরা জ্যোৎস্না যেন দপ করে নিভে
গেল! একটা অপ্রত্যাশিত আঘাতের বেদনায় সমস্ত দেহ আমার অনেকক্ষণের জন্যে
নিসাড় হয়ে রইল। কখন যে মাথা ঘুরে পড়ে পাশের বেঞ্চিটার হাতায় লেগে আমার
চোখের কাছে অনেকটা ফেটে গিয়ে তা দিয়ে ঝর-ঝর করে খুন ঝরছিল, আর পরি তার
আঁচলের খানিকটা ছিঁড়ে আমার ক্ষতটায় পটি বেঁধে দিয়েছিল, তা আমি কিছুই জানতে
পারিনি! যখন চোখ মেলে চাইলুম, তখন পরি আমার আঘাতটাতে জল চুঁইয়ে দিচ্ছে, আর
সেই চোঁয়ানো জলের চেয়েও বেগে তার দুই চোখ বেয়ে অশ্রু চুঁয়ে পড়ছে! … এতক্ষণে
আহত অভিমান আমার সারা বক্ষ আলোড়িত করে গুমরে উঠল! বিদ্যুদ্বেগে সোজা হয়ে
দাঁড়িয়ে আহত স্বরে বললুম, ‘বড়ো ভুল হয়েছে পরি, তুমি আমায় ক্ষমা করো!’
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে যেন কী সামলে নিয়ে, তার পরে আনমনে চিবুকছোঁয়া
তার একটা পীত গোলাবের পাপড়ি নখ দিয়ে টুঙতে টুঙতে অভিভূতের মতো কী বলে উঠল!
আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলুম না, বললুম, ‘তবে যাই পরি!’
অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘আহ্, তাই যাও!’
কিন্তু জ্যোৎস্না-বিবশা নিশীথিনীর মতোই যেন তার চরণ অবশ হয়ে উঠেছিল, তাই
কুণ্ঠিত অবগুণ্ঠিত বদনে সে পাথরের মতো সেইখানে দাঁড়িয়েই রইল। যখন দেখলুম
হেমন্তে শিশির-পাতের মতো তার গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, তখন অতি কষ্টে
আমার এক বুক দীর্ঘশ্বাস চেপে চলে এলুম। তখন তীক্ষ্ণ ক্লেশের চোখা বাণ আমার
বাইরে ভিতরে এক অসহনীয় ব্যথার সৃষ্টি করছিল। মনে হচ্ছিল, এই চাঁদিমা-গর্বিত
যামিনীর সমগ্র বক্ষ ব্যেপে সাহানা সুরের পাষাণ-ফাটা কান্না আকণ্ঠ ফুঁপিয়ে
উঠছে, আর তাই সে শুধু সিক্ত চোখে মৌন মুখে আকাশ-ভরা তারার দিকে তাকিয়ে
ভাবছে, আকাশের মতো আমারও মর্ম ভেদ করে এমনই তো কোটি কোটি আগুন-ভরা তারা
জ্বলছে, উষ্ণতায় সেগুলো মার্তণ্ডের চেয়েও উত্তপ্ত। স্থির সৌদামিনীর মতো
সেগুলো শুধু জ্বালাময়ী প্রখর তেজে জ্বলছে – ধু-ধু-ধু!
* * *
এটাও একবার কিন্তু মনে হয়েছিল সে দিন যে, আহ, কী হতভাগা আমি! যা পেয়েছিলাম,
তাতেই সন্তুষ্ট থাকলুম না কেন, তাকে দেখতে পেয়েই পালিয়ে এলুম না কেন?
দূরে ওই একটু অনুরাগ সঞ্চিত সলাজ চাউনি, – নানান কাজের অনর্থক ব্যস্ততার
আড়ালে দু-তিন বার দৃষ্টি-বিনিময়, হঠাৎ একটি শিহরণ ভরা পরশ, – যাই-যাই করেও
না যেতে পারার মাধুরীময় সলজ্জ কুণ্ঠা, মুখর হাসি ওষ্ঠ-অধরের নিষ্পেষণে
চাপতে গিয়ে চোখের তারায় ফুটে ওঠা, আর সেই শরমে কর্ণমূলটি আরক্ত হয়ে ওঠা –
এই সব ছোটোখাটো পাওয়া আর টুকরো টুকরো আনন্দের গাঢ় অনুভূতি আমার প্রাণে যে
এক নিবিড় মাধুরীর মাদকতা ঢেলে নেশায় মশগুল করে রেখেছিল, তার চেয়েও বেশি আমি
তো আর পেতে চাইনি, তবে কেন সে আমায় এমন অপমান করলে?
আমি তাকে ভালোবেসে আসছি, সে-যে কবে থেকে তার কোনো দিন-ক্ষণ মনে নেই; বড়ো
প্রাণ দিয়েই ভালোবেসেছি তাকে, কিন্তু কোনো দিন কামনা করিনি। আগেও মনে হত আর
আজও হয় যে, তাকে না পেয়ে আমার জীবনটা ব্যর্থই হয়ে গেল, তবু প্রাণ ধরে কোনো
দিনই তো তাকে কামনা করতে পারিনি। বরং যখনই ওই বিশ্রী কথাটা – মিলন আর
পাওয়ার এবড়ো-খেবড়ো দিকটা, একটুখানির জন্যে মনের কোণে উঁকি মেরে গিয়েছে,
তখনই যেন লজ্জায় আর বিতৃষ্ণায় আমার বুক এলিয়ে পড়েছে । এত ভুবন-ভরা ভালোবাসা
আমার কি শেষে দুদিনেই বাসি হয়ে পড়তে দেব? – ছি ছি! না না!
সেদিন মনে হয়েছিল, যে ভালোবাসা দুজনের দেহকে দুদিক থেকে আকর্ষণ করে মিলিয়ে
দেয়, সে তো ভালোবাসা নয়, সেটা অন্য কিছু বা মোহ আর কামনা। হয়তো এই মোহটাই
শেষে ভালোবাসায় পরিণত হতে পারত এমনই দূরে দূরেই থেকে, কিন্তু এক নিমিষের
মিলনেই সে পবিত্র ভালোবাসা কেমন বিশ্রী কদর্যতায় ভরে গেল! প্রেমের মিলন তো
এত সহজে এমন বিশ্রী হয় না! তাই জীবন আমার ব্যর্থ হবে জেনেও আমি প্রাণ থাকতে
তার সঙ্গে মিলিনি। জীবনভরা দুঃখ আর ক্লেশ-যাতনা অপমানের পসরা মাথা পেতে
নিয়েছি, তবু আমি ভুলেও ভাবতে পারিনি যে, এমনই নির্লজ্জের মতো এসে এই
আঁধারে-পথের মামুলি মিলনে আমার প্রিয়ার অবমাননা করি। আমি জানি, এমন করেই
তাকে এমন করে পাব, যে-পাওয়া সকলে পায় না। কেউ বলে না দিলেও আমার বিশ্বাস
আছে যে, আজ যাকে ব্যর্থ বলে মনে করছি, আমার জীবনে সেই ব্যর্থতাই একদিন
সার্থকতায় পুষ্পিত পল্লবিত হয়ে উঠবে – …আ মলো, – কী লিখতে গিয়ে কী সব বাজে
কথা লিখছি! হাঁ, কী বলছিলুম? তাকে ভালোবাসি বলেই তাকে এমন করে এড়িয়ে এলুম,
এই কথাটা বুঝতে না পেরেই কী সে আমায় এমন করে প্রত্যাখ্যান করলে! – হায়!
প্রাণ প্রিয়তমের পাওয়াকে এড়িয়ে চলবার ধৈর্য আর শক্তি পেতে যে আমি কত বেশি
বেদনা আর কষ্ট পেয়েছি, তা তুমি বুঝবে না পরি – বুঝবে না! তবু কিন্তু বড়ো
কষ্ট রয়ে গেল যে, হয়তো তুমি আমার ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে পারলে না। তোমায়
অন্যকে বিলিয়ে দিয়ে তোমায় যত বেদনা দিয়েছি, তার চেয়ে কত বেশি ব্যথা যে
আমাকে চাপতে হয়েছে, কতো বড়ো কষ্ট যে নীরবে সইতে হয়েছে, তা যদি তুমি জানতে
পারতে পরি, তাহলে সেদিন এই কথাটা মনে করে আমায় এতো বড়ো আঘাত করতে পারতে
না।…
আমি জানি প্রিয়, সেদিন তোমার আসবেই আসবে, যেদিন আমার এই অভিশপ্ত জীবনের সকল
কথা সকল আশা অন্তত তোমার কাছে লুকানো থাকবে না। এ তুমি নিজেই আপনা-আপনি
বুঝতে পারবে, কাউকে তা বলে দিতে বা বুঝিয়ে দিতে হবে না। কিন্তু সেদিন কি
আমি আর এ-জীবনে জানতে পারব প্রিয়, তুমি আমায় ভুল বোঝনি? তা যদি না জানতে
পারি, তবে আপশোশ প্রিয়, আপশোশ! …
এই নাও, আমার সব গুলিয়ে গেল দেখছি! এ যেন ঠিক ঘুমের ঘোরে হাজার রকমের
স্বপ্ন দেখার মতো! কোনোটার সঙ্গে কোনোটারই সামঞ্জস্য নেই, অথচ অলক্ষ্য থেকে
স্বপ্ন-রানি সবগুলিকে একটি ক্ষীণ সুতো দিয়েই গেঁথে দিচ্ছে! আমার সব
কথাগুলো যেন ঠিক লাখো ফুলের এলোমেলো মালা!
আবার আমার মনে হচ্ছে আমার পক্ষে তার কাছে ও-রকম করে কথা কওয়া বা দেখা দেওয়া
কিছুতেই উচিত হয়নি। কেননা সে নিশ্চয় মনে করেছিল যে, আমি আমার মিথ্যা
অহংকারকে কেন্দ্র করে তার কাছে ত্যাগের গর্ব দেখাতে গিয়েছিলুম, আর তাই হয়তো
যখন এই কথাটা তার হঠাৎ মনে হল অমনি কেমন একটা বিতৃষ্ণায় তার মন ভরে উঠল,
আর সে আমায় ও-রকম নির্দয়তা না দেখিয়েই পারলে না। – আর একটা কথা, কেউ একটু
সামান্য প্রশ্রয় দিলেই আমাদের মতো স্নেহ-বুভুক্ষু হতভাগারা এতটা বাড়াবাড়ি
করে তোলে যে, সে তখন এই দুর্ভাগাদের চেতন করিয়ে দিতে বাধ্য হয়, আর আমরা
সেইটাকে হয়তো অপমানের আঘাত বলেই মনে করি। এটা তো আমাদেরই দোষ। –
অন্তরের গোপন কথা অন্তরেই না রাখতে পেরে বাইরে প্রকাশ করে দেওয়ার যে
দুর্বার লজ্জা আর অক্ষমণীয় অপমান, তা হতে আমায় রক্ষা করো খোদা, রক্ষা করো!
এর যা শাস্তি, তা বড়ো নির্মম নিষ্করুণ হয়েই আমার মাথার উপর চাপাও।
কিন্তু ঘুমের ঘোর আমার এখনও কাটেনি। মন এমন একটা জিনিস বা মনের এমন একটা
দুর্বলতা আছে যে, সে সহজে কোনো জিনিসের শক্ত দিকটা দেখতে চায় না। বুঝলেও
অবুঝের মতো সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চলতে চায়! কিন্তু আশ্চর্য এই যে, কে যেন
মুণ্ডটা ধরে ওই নিষ্করুণ নীরস দিকটাই দেখতে বাধ্য করায়; সে বোধ হয়, মনেরই
পেছনে প্রচ্ছন্ন একটা দুর্নিবার শক্তি।
দেখেছ মজা! আমার মন এটা নিশ্চয়ই জেনে বসেছে যে, সে আমাকে আমার চেয়েও বেশি
ভালোবাসে। তবে সেদিন যে সে আমায় অপমান করে তাড়িয়ে দিলে? সে বড়ো দুঃখে গো,
বড়ো দুঃখে! তার মতো অভিমানিনীর আত্মমর্যাদাকে ডিঙিয়ে চলার সামর্থ্য নেই।
তাই বড়ো কষ্টে তাকে এত শক্ত হতে হয়েছিল, নইলে ওই নিষ্ঠুর কথাটা বলবার পরই
কেন হুহু করে অশ্রুর হড়পা-বান বয়ে গেল তার চোখের বুকের সব আবরণ ভাসিয়ে
দিয়ে! সব মিথ্যা হতে পারে, কিন্তু ওইটা – এত বড়ো একটা সত্য তো মিথ্যা হতে
পারে না। অন্ধ, তুমি সেই সময় যদি তার মর্মন্তুদ ব্যথার বেদনা বুঝতে পারতে,
তার এই অভিমান-বিধুর অকরুণ কথার উৎস কোথায় দেখতে পেতে, তাহলে আজ ওই মিথ্যা
দুঃখটা তোমায় এত কষ্ট দিত না! সে যদি এত বেশি অভিমানিনী না হত, তা হলে
সাধারণ রমণীর মতো অনায়াসে তোমার পায়ে মুখ গুঁজে পড়ে কেঁদে উঠত, – ওগো,
অকরুণ দেবতা! খুব করেছ! খুব উদারতা দেখিয়েছ, আর এ হতভাগিনিকে জ্বালিও না!
এতই দেবত্ব দেখাতে চাও যদি, তবে এসো না। কিন্তু তা হলে তো ‘আমার প্রিয়
মহান!’ এই কথাটির গৌরবে আমার রিক্ত বুক এমন করে ভরে উঠতে পারত না! – ভালোই
করেছ খোদা, তুমি ভালোই করেছ! প্রতিদিনের মতো আজ তাই বড়ো প্রাণ হতেই বলেছি, –
তুমি চির মঙ্গলময়! আবার বলছি, – ‘তোমারই ইচ্ছা হউক পূর্ণ করুণাময় স্বামী!’
* * *
এ আর এক দিনের কথা! … পরি তার তে-তলার দালানের কামরায় বসে নিশীথ-রাতের
সুষুপ্তিকে ব্যথিয়ে আনমনে গাচ্ছিল, – দিগ্বালারা আজ জাগল না। নব-ফাল্গুনে
মেঘ করেছে। মুখর ময়ূরের কলকণ্ঠের সাথে মাঝে মাঝে আকুল মেঘের ঝমঝমানি শোনা
যাচ্ছে, ঝিম ঝিম ঝিম! … নিত্যকার নৃত্যমুখর প্রভাত এখন রোজই স্তব্ধ হয়ে
শুধু ভাবে আর ভাবে। বর্ষণ-পুলকিত পুষ্প-আকুলিত এই বল্লি-বিতানের
আর্দ্র-স্নিগ্ধ ছায়ে বসে আমার মনে হয়, আমার প্রিয়তমাকে আমি হারিয়েছি, আবার
মনে হয়, না, বড়ো বুক ভরেই পেয়েছি গো, তাকে পেয়েছি! – আজ আমার ফুল-শয্যার
নিশিভোর হবে। এ ভোরে বারিও ঝরবে, বারি-বিধৌত ফুলও ঝরবে, আবার শিশুর-মুখের
অনাবিল-হাসির-মতো শান্ত কিরণও ঝরবে। – ওগো আমার বসন্ত-বর্ষার বাসরনিশি তুমি
আর যেয়ো না – হায় যেয়ো না!
আমার বিজন কুটিরে সেই গান আমার বিনিদ্র কানে যেন এক রোদন-ভরা প্রতিধ্বনি
তুলছিল। – আমি ভাবছিলুম যে, হায় মাঝে আর তিনটি দিন বাকি! তার পর এই পনেরো
বছরের চেনা-গলার মিঠা আওয়াজ আর শুনতে পাব না, এই আমার বিশ বছরের জীবনে
জড়িয়ে-পড়া নিতান্ত আপনার মানুষটিকে হারাতে হবে। কিন্তু হয়তো সারা জনম ধরে
এরই রেশ আমার প্রাণে বীণার ঝংকার তুলবে। … এই তিনটি দিনই মাত্র তাকে আমার
বলে ভাবতে পারব, তার পরে আমার কাছে তার চিন্তাটা যেমন দূষণীয়, তার কাছেও
আমার চিন্তাটা সেই রকম অমার্জনীয় অপরাধ হবে! আর এক জনের হয়ে সে কোনো দূর
দেশে চলে যাবে, আমি চলে যাব সে কোন্ বাঁধনহারার দেশ পেরিয়ে। তার পর দীর্ঘ
বিধুর-মধুর অলঙ্ঘনীয় একটা ব্যবধান! …
এই সব কথা মনে পড়তেই আমি বৃষ্টি-ধারার ঝম-ঝমানির সাথে গলায় সুর বেঁধে
গাইলুম, – ওগো প্রিয়তম, এসো আমরা দু-জনেই পিয়াসি চাতক-চাতকীর মতো কালো
মেঘের কাছে শান্ত বৃষ্টি-ধারা চাই। আমরা চাঁদের সুধা নেব না প্রিয়! আমরা তো
চকোর-চকোরী নই। চাতক-মিথুন বাদলের দিনে আমরা চাইব শুধু বর্ষণের পূত আকুল
ধারা। এসো প্রেয়সী আমার, এই আমাদের ফাল্গুনের মেঘ-বাদলের দিনে আমরা উভয়ে
উভয়কে স্মরণ করি আর চলে যাই! এই বসন্ত-বর্ষার নিশীথিনীর মতোই আমার মনের
মাঝে এসো তোমার গুঞ্জরণ-ভরা ব্যথিত চরণ ফেলে! … তার পরে দূরে দাঁড়িয়ে সজল
চারিটি চোখের চাউনির নীরব ভাষায় বলি, – ‘বিদায়’! …
সে আমার গান শুনেছিল কিনা জানি নে। কিন্তু সে সময় মেঘের ঝরা থেমেছিল, আর
তার বাতায়ন চিরে ম্লান একটু দীপশিখা আমার বিজন কুটিরে কাঁপতে কাঁপতে
নেমেছিল! … তার পরে ঝড়ো হাওয়ার সাথে মেতে আগল-ছাড়া পাগল মেঘের ওই একরোখা
শব্দ, – রিম্ – ঝিম্ – রিম। …
* * *
বিসর্জনের দিন। নহবৎ-খানায় তারই বিসর্জনের বাজনা বাজছে। সান্ত্বনা আর
অশান্ত একবুক বেদনা – এই দুটো মিলে আমায় এমন অভিভূত করে ফেলেছে যে, অতি
কষ্টে আমার এ শ্রান্ত দেহটাকে খাড়া করে রেখেছি। আর – আর একটু পরেই যেন
খুঁটি-দিয়ে খাড়া করা এই জীর্ণ ঘরটা হুড়মুড় করে ধসে পড়বে। …
বাইরে বেরিয়ে এলুম। সেখানেও ওই একই একটা অস্বস্তি আর অরুন্তুদ যন্ত্রণা!
নিদাঘ সাঁঝের ধূসর আকাশ ব্যথায় উদাস-পাণ্ডুর হয়ে ধরার বুক আঁকড়ে হুমড়ি খেয়ে
পড়েছিল, আর অলক্ষ্যে ক্রমেই সে বেদনায় গুমোট কালো জমাট হয়ে আসছিল। আমের
মুকুলের সাথে পাশের গোরস্থান থেকে গুলঞ্চের মালঞ্চ যে করুণ সুগন্ধের আমেজ
দিচ্ছিল, তাতে আমি কিছুতেই কান্না চেপে রাখতে পারছিলুম না। ওঃ! সে কী
দুর্জয় অহেতুক কান্নার বেগ! এই রোদনের সাথে একটা ক্লান্তি-ভরা স্নিগ্ধতাও
যেন ফেনিয়ে আমার ওষ্ঠ পর্যন্ত ছেপে উঠেছিল!
* * *
পরির বিয়ে হল। দৃষ্টি-বিনিময় হল। সম্প্রদান হল। তার পরেই আমি আর এই কথাটা
গোপন রাখতে পারলুম না, যে, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। তখন সকলেই এক বাক্যে স্বীকার
করলে যে, আমাদের মতো আত্মীয়-স্বজনহীন ভবঘুরে হতভাগাদের জন্যেই বিশেষ করে
এই সৈন্যদলের সৃষ্টি! আমিও মনে মনে বললুম, – ‘তথাস্তু’। – দু-একজন বন্ধু
মামুলি ধরনের লৌকিকতা দেখিয়ে একটু-আধটু দুঃখ প্রকাশও করলেন। সেদিন কেঁদেছিল
শুধু আমার দূর সম্পর্কের একটি ছোটো বোন। তাই তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সে
বললে, – ‘যাও ভাই-জান! হয়তো আর তোমায় ফিরে পাব না! তবু কিন্তু তুমি বড়ো
একটা কাজে যাচ্ছে যে, সেটায় বাধা দেওয়াও মস্ত পাপ আর স্বার্থপরতা। এমন একটা
কাজে জীবন উৎসর্গ করতে গেলে দেশের কোনো বোনই যে তার ভাইকে বাধা দিতে পারে
না! আমাদের দেশে বীরাঙ্গনা থাকলেও বীর-ভাইদের বোন হওয়ার মতো সৌভাগ্যবতী
অনেক রমণী আছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই নিজের ভাইকে বীর-সাজে সাজিয়ে দেশরক্ষা করতে
পাঠাতে পারেন। ভুলে যেয়োনা ভাই-জান যে, রণদুর্মদ মুসলমান জাতির উষ্ণ রক্ত
আমাদেরও দেহে রয়েছে! আমরাও আসছি সেই এই একই উৎস হতে। এ রক্ত তো শীতল হবার
নয়!’ …
আমি আমার এই মুখরা বোনটিকে বড়ো বেশি স্নেহ করতুম। তাই তার সেদিনকার এই সব
কথায় গৌরবে আমার বুক ভরে উঠেছিল! আমার অসংবরণীয় অশ্রু রুখতে গিয়ে দেখলুম
ততক্ষণে আমার ছোটো বোনের চোখ দুটি জলে ভাসছে! তাকে আর কখনও কাঁদতে দেখিনি।
একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে অশ্রু-বিকৃত কণ্ঠে সে আমায় বললে, – ‘তোমাকে কেউ বাধা
দিতে নেই বলে তুমি হয়তো অন্তরে বড়ো কষ্ট পাচ্ছ ভাইজান, কিন্তু এটা নিশ্চয়
জেনো যে, আমার মতো আজ অনেকেই তোমার কথা ভেবে লুকিয়ে কাঁদছে! – হাঁ, একটা
কথা । একবার আমার সই পরিদের বাড়ি যাও। এ শেষ দেখায় কোনো লজ্জা-শরম কোরো না
ভাই! পরি বড়ো অস্থির হয়ে পড়েছে, তার অন্তিম অনুরোধ, একবার তাকে দেখা দাও।’ …
হায় রে সংসার-মরুর স্নেহ-নির্ঝরিণী-স্বরূপা ভগিনিগণ! তোরা চিরকালই এমনই
সন্ন্যাসিনী, অথচ ভারে ভারে পবিত্র স্নেহ ঘরে ঘরে বিলিয়ে বেড়াচ্ছিস! বড়ো
দুঃখ তোদের সহজে কেউ চেনে না। যে হতভাগার বোন নেই, সেই বোঝে তার দুঃখ কষ্ট
কত বড়ো! মুখে অনেক সময় তোদের কষ্ট দেবার ভান করলেও তোরা বোধ হয় সহজেই
বুঝিস, যে, আমাদেরও বুকে তোদেরই মতো অনাবিল একটি স্নেহ-প্রীতির প্রশান্ত
ধারা বয়ে যাচ্ছে, তাই তোরা মুখ টিপে হাসিস। আবার কাজের সময় কেমন করে এত বড়ো
তোদের স্নেহ-বেষ্টনীকে ধূলিসাৎ করে দিস!
আমার এই বড়ো গৌরবের, বড়ো স্নেহের বোনটিকে আশীর্বাদ করবার ভাষা পাইনি সেদিন!
তার আনত মস্তকে শুধু দু-ফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আমার প্রাণের
মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা জানিয়েছিল।
খুব সহজেই পরির সঙ্গে দেখা করতে গেলুম। এই নির্বিকার তৃপ্তিতে আমার নিজেরই বিস্ময় এল! কী করে এমন হয়? …
পরি নববধূর বেশে এসে যখন আমার পা ছুঁয়ে সালাম করলে, তখন বরষার স্রোতস্বিনীর
চেয়েও দুর্বার অশ্রুর বন্যা তার চোখ দিয়ে গলে পড়ছে! মুহূর্তের জন্যে
দুর্জয় একটা ক্রন্দনের উচ্ছ্বাসে আমার বুকটা যেন খান খান হয়ে ভেঙে পড়বার
উপক্রম হল। প্রাণপণে আমি আমার অশ্রুরুদ্ধ কম্পিত স্বরকে সহজ সরল করে তার
মাথায় হাত রেখে স্নিগ্ধ-সজল কণ্ঠে বললুম, ‘চির-আয়ুষ্মতী হও! সুখী হও!’
সে শুধু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল! তার পর মহিমময়ী রানীর মতোই চলে গেল!
যখন আমার ভাঙা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে একবার চারিদিকে শেষ-চাওয়া চেয়ে নিলুম,
তখন মনে হল যেন সজনে ফুলের হাত-ছানিতে আমার পল্লি-মাতা আমায় ইশারায় বিদায়
দিলে! একবার নদীপারে শিমুল গাছটার দিকে চেয়ে মনে হল যেন তার ডালে ডালে
নিরাশ প্রেমিকের ‘খুন-আলুদা
’ হৃৎপিণ্ডগুলি টাঙানো রয়েছে! … সে দিন ছল-ছল ময়ূরাক্ষীর নির্মল ধারা তেমনই মায়ের বুকের শুভ্র ক্ষীর-ধারার মতোই বয়ে যাচ্ছিল!
স্বপ্নের মতো বিহ্বলতায় ভরা সে কোন্ সুরপুর হতে আধঘুমে গানের প্রাণস্পর্শী ব্যঞ্জনা আমার কানে এল, –
অনেক দিনের অনেক কথা ব্যাকুলতা, বাঁধা বেদন-ডোরে,
মনের মাঝে উঠেছে আজ ভরে!’
শান্তির মতো শুভ্র এক-বুক পবিত্রতা নিয়ে এই অজানার দিকে তখন পাড়ি দিলুম! –
আর একটিবার আমার শূন্য ঘরটার দিকে অশ্রু-ভরা দৃষ্টি ফিরিয়ে আকুল কণ্ঠে কয়ে
উঠলুম, – ‘জয় অজানার জয়!’