গল্প :: সাবিত্রী।
--- সুজন কুতুবী।
তাং ৩১/০৫/২০১৬।
.
আমি জন্মেছিলাম মালো পাড়ায়। সমাজে
আমাদের কোন মূল্যায়ন ছিলোনা। প্রথমত
মালোপাড়ার অধিবাসী দ্বিতীয়ত আমরা
ছিলাম নিম্নবর্ণের হিন্দু। আমি আমার
বাল্যকালে দেখেছি সমাজের উচ্চবৃত্তদের
দেয়া কাজই ছিলো আমাদের আয়ের উৎস।
তাছাড়া মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করা
আমাদের আদি পেশা।
যে ঘরে আমি আর আমার মা থাকতাম
সেটি ছিলো তালপাতার চাউনি আর
বাঁশের বেড়া। যদিও বর্ষাকালীন সময়ে
তেমন বৃষ্টি পড়েনা তবে বেড়ার ফাঁক দিয়ে
বাইরের সবকিছু দেখা যায় অনায়সে।
বাসাটা ছিলো এক রুমের। আমি আর আমার
মায়ের জন্যে এটি অনেক বড় ঘর। আমার
নানা-নানি কিংবা দাদা-দাদি আছে
কিনা জানিনা। থাকলে কোথায় থাকে
তাও জানিনা।
আমার বাবা ছিলোনা। বাবার নাম মা
বলতে পারেনি বলে স্কুলে ভর্তি হতে
পারিনি। তাছাড়া স্কুলে পড়ার খরচ বা
ইচ্ছা কোনটাই মায়ের ছিলোনা । গ্রামের
লোকগুলো মাকে কলঙ্কিনী বলে ডাকে।
এটি কি মায়ের নাম নাকি আর কিছু তাও
বুঝিনা। আমার দিকে ওরা বাঁকা চোখে
তাকাতো। আমি ওদেরকে ভয় পেতাম বলে
পাড়ার দোকান পাটে যেতামনা। যদি
কোনদিন যাই তবে পাড়ার ছেলেদের হাতে
প্রচুর মার খেতে হতো। ওরা বলতো, " তোর
বাবা নাই, তুই একটা জারজ। " বাসায় ফিরে
প্রায়শই মাকে বলতাম, "মা, আমার বাবা
নাই কেন? সবাই আমাকে জারজ বলে কেন?
জারজ মানে কী? " মা নিশ্চুপ হয়ে
থাকতো। কোন প্রশ্নের জবাব দিতোনা
কিংবা দিতে পারতো না। আমিও একই
প্রশ্ন বারবার করে বিরক্ত হয়ে
গিয়েছিলাম বলে উত্তর পাবোন জেনে
প্রশ্ন করা ছেড়ে দিই। বাড়িবাড়ি গিয়ে
মা কাজ করতো। আসার সময় বাড়ির
কর্তীরা মাকে কিছু চাল, কিছু তরকারী
দিতো। কেউ কেউ আবার কিছু টাকাও
দিতো। আমরা সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম
যখন মা কিছু বাসি তরকারী পেতো। বাসি
তরকারী হলে রান্না করার ঝামেলা নাই।
তেল নষ্ট হবেনা। তেল কিনার টাকাও
আমাদের থাকতোনা। তাই বাসি
তরকারিতেই এতো খুশি হতাম। এভাবেই
চলছিলো আমাদের মা-ছেলের সংসার খরচ।
আমি ছোট ছিলাম বলে আমাকে কোনদিন
কাজে যেতে হয়নি। মা একাই যেতো।
কোন সময় মায়ের ফিরতে দেরি হয়ে গেলে
আমার বাসায় একাএকা ভয় করতো। কী
জানি জ্বিন, ভুত আসে কিনা! এসব ভাবতে
ভাবতে মা এসে পড়তো। এরকম অনেক রাত
মাকে দৌড়ে বাসায় ঢুকতে দেখেছি।
বাসায় ঢুকে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে
দিয়ে কাঁপতে থাকতো। কী হয়েছে জানতে
চাইলে মা কিছু বলতো না। কোন সময়
দেখেছি কাজ না করেই সন্ধ্যে বেলার
অনেক আগেই বাসায় ফিরে এসেছে। বাসায়
ফিরে মনমরা হয়ে মুখভার করে বসে
থাকতো। মাকে জিজ্ঞেস করতাম, "মা
আজকে কাজ করবে না? " মা না সূচক জবাব
দিতো। তাহলে রাতে খাবো কী? পরদিন
সকালে আর দুপুরে কী খাবো? " মা কান্না
করতো আর বলতো জানিনা।
এভাবে চলতে চলতে এরই মধ্যে বরষা এসে
গেলো। বড়লোকের ছেলেরা রেইনকোট পড়ে
রাস্তায় বের হতো। আমারও মন চাইতো
রেইনকোট পড়ে রাস্তায় বের হতে। কিন্তু
রাস্তায় বের হলেই ওরা মারবে তাই
রেইনকোট কিনে দেয়ার জন্যে মাকে বলতে
পারতাম না। তাছাড়া এতো টাকা দিয়ে
রেইনকোট কীভাবে কিনবে? একরাতে খুব
বৃষ্টি হচ্ছিলো। শীত শীত লাগছিলো প্রচুর।
বাড়িতে গরম কাপড় বলতে একটা
জীর্ণশীর্ণ কাঁথা। দুইজনে কোনরকম
জড়াজড়ি করে শুয়েছিলাম। তবুও শীত
মানতেছিলো না। তাই একটু উষ্ণতা লাভের
আশায় দুইজনই আরো গা ঘেষে শুয়েছিলাম।
হঠাৎ কি হলো কী জানি মা আমাকে আরো
জড়িয়ে ধরে কান্না করতেছিলো। আমার
মাথায় সারা রাত হাত বুলাতে বুলাতে কে
কখন ঘুমিয়েছি কিছুই জানি না।
প্রতিদিনকার মতো মা গিয়েছিলো
লোকেদের বাড়িতে কাজ করতে । আমি
বাড়িতেই ছিলাম। হঠাৎ দেখি মা যে সময়
কাজ করে বাসায় ফেরে তার অনেক আগেই
চলে এসেছে। মায়ের কাপড় সব ছেড়া।
মায়ের মুখে, বুকে আরো অনেক জায়গায়
আছড়ের দাগ। মা কাঁপতে কাঁপতে বাসায়
ফিরছিলো আর অনেক কান্না করছিলো।
"মা, কী হয়েছে তোমার? তোমার শাড়ী
কই? গায়ে এতো দাগ কেন? "
"কিছু হয়নি বাবা। আমি ঠিক আছি। "
"তোমার গা থেকে রক্ত বের হচ্ছে, আর তুমি
বলছো তুমি ঠিক আছো! "
"ওসব তুই বুঝবিনা বাবা । মেম্বারের
বাড়িতে একটা বড় কুকুর আছে। ঐ কুকুরই করছে
এসব। "
কিন্তু কই মেম্বারের বাড়িতেতো কোনদিন
কুকুর দেখি নাই। আর তুমি বলছো বড় কুকুর।!"
এই জন্যেইতো বলতেছি ওসব তুই বুঝবিনা। "
পরদিন মাকে ডাকা হলো সালিশে। মা
আমাকে ছাড়াই গিয়েছিলো মোড়লের
সালিশে।
আমিও কী হয় দেখার জন্যে মায়ের
অজান্তে চুরি করে ঐ সালিশে একপাশে
গিয়ে মাথা নিচু করে বসেছিলাম যাতে
মা দেখতে না পায়।
সমাজের মোড়ল একেক জনের কাছ থেকে
বক্তব্য শুনলেন। শেষে মায়ের কাছে
জানতে চাইলেন কী হয়েছিলো গতকাল। মা
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করে বলেছিলো, "
আমার কোন দোষ নেই, আমাকে জোর
করে.......এইটুকু বলে আরো জোরে কেঁদে
ওঠলো। ঐদিন সবার স্বিদ্ধান্তক্রমে মায়ের
মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। যদিও মা
তাদের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে
ছটপট করছিলো এমন কি সবার পায়েও
ধরেছিলো। "আমাকে ছেড়ে দেন, আমি
নির্দোষ ।"...... আমরা মালো ছিলাম বলে,
সমাজের নিম্ন শ্রেণির ছিলাম বলে,
আমাদের মা-ছেলের কোন আত্মীয় স্বজন
ছিলোনা বলে কেউ শুনেনি মায়ের কথা।
আমিও মায়ের সাথে ছাড়া পাওয়ার জন্যে
অনেক আকুতি করেছিলাম। মায়ের মাথা
ন্যাড়া করে চুন মাখিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরানো
হয়। আমি এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম
মেম্বারের ছেলের সাথে মায়ের কিছু
একটা ঘটেছে। কিন্তু কী ঘটেছে তা ঐটুকু
বয়সে বুঝে ওটতে পারছিলামনা। আমি এখন
প্রাপ্ত বয়স্ক। এখন অনেক কিছু বুঝি। কে
আমি? কী আমার পরিচয়? আমার জন্ম
কীভাবে হয়েছে? মা কেন কাঁপতে কাঁপতে
বাসায় দৌড়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিতো?
কেন লোকদের বাড়ি কাজ না করে বাড়ি
ফিরে এসে কান্না করতো। আমার
মমতাময়ী মায়ের উপর সমাজের
বিত্তশালীদের দৈহিক নির্যাতনের ফল
আমি। এরকম হাজার প্রশ্নের জবাব আমার
কাছে এখন আছে। যার উত্তর মা আমাকে
তখন দিতে পারেনি। পাঠক সমাজ আপনারা
মানবিক দিক বিচার করে একবার ভেবে
দেখুন, একজন মা কী করে তার পাঁচ বছরের
ছেলের কাছে তার উপর ঘটে যাওয়া
নির্যাতনের কথা বর্ণনা করবে? পরদিন মা
একজনকে কিছু টাকা দিয়ে আমার জন্যে
কিনে নিয়ে এসেছিলো রেইনকোট। এই
গরমের দিনে রেইনকোট কেন কিনলো তা
কিছুই বুঝতে পারিনি । আমাকে সাবান
দিয়ে ভালো করে স্নান করিয়ে দিয়ে
রেইনকোট
পরিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে অনেক করে
দেখলো। কাউকে দিয়ে বাজার থেকে
ভালো মাছ কিনে রাতে রান্না করা হলো।
মায়ের হাতে যে কিছু টাকা জমানো
ছিলো তা আমি জানতাম না। রাতে মা
আমাকে জড়িয়ে ধরে
অনেকগুলো চুমু খেলো। সারারাত আমার
মাথায় হাত বুলাতা বুলাতে কান্না
করেছিলো।
রাতে কে কখন ঘুমিয়েছি মা আগে নাকি
আমি কিছুই টের পাইনি। সকালে ঘুম থেকে
জেগে দেখি রুমের মধ্যে কীসের যেন প্রচন্ড
গন্ধ। মাকে অনেক করে ডাকলাম। মা,
দেখো রুমের মধ্যে কী বাজে গন্ধ। মা ঘুম
থেকে জাগতেছেনা। মনেহয় গভীর রাতে
ঘুমিয়েছে। তাই ঘুম থেকে জাগানোর জন্যে
মায়ের বাহু ধরে ঝাকি দিয়ে অনেক করে
ডাকলাম। মা, মা, মা,...........। ওঠো, দেখো
কীসের গন্ধ আসতেছে। কিন্তু মা ঘুম থেকে
আর জাগেনি। মায়ের মুখ দিয়ে সাদা
ফেনা বের হচ্ছিলো। আর বালিশের পাশে
ছিলো একটি কাচের ছোট বোতল।
 
Top