গল্প

অন্তরত্মা (পর্বঃ১)/ শিহাব
আজি আলিফ শেখের মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হইয়াছে। বাড়ির পিছনের ঐ বটগাছের নিচে বসিয়া আলিফ শেখ একান্ত চিত্তে কি যেন ভাবিতে লাগিলো। মুহূর্তেরর মধ্যে দৃশ্যপটের পরিবর্তন, আলিফের ইন্দ্রিয়ে কান্নার অঝর শ্রাবণ ধারা শুরু হইলো। আলিফ আজ তার গত হয়ে যাওয়া বন্ধুদের শোকে কান্নারত, এই ভেবে যে- তাহাদিগের সাথে হয়তো আলিফের আর দেখা হইবে না। মাধ্যমিক পাশ করিলে আলিফকে শহরে ফুফুর বাড়িতে থেকে কলেজে পড়াশুনা করিতে হবে, সাফ জানিয়ে দিয়েছে আলিফের পিতা জম্মুল শেখ। পিতার এরকম সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ আলিফ, পিতার কথা আবার অগ্রাহ্য করিবে এ প্রকৃতির মানুষ আলিফ নহে। মাকে ছাড়িয়া এক মুহূর্তেও চলিতে পারে না আলিফ। মাকে ছাড়িয়া তাহাকে একা থাকিতে হবে, কখনো ইহা একান্ত চিত্তে ভাবিয়া দেখে নাই আলিফ। মায়ের নিকট সন্তানের আবদার ঐ একটাই- 'মা, তোকে ছাড়িয়া আমি কোনখানে যামু না। জন্মের পরে তোর কোলে ছিলাম আর মৃত্যু যেন তোর কোলেই হয়"। শহরে যাইতে আরও প্রায় একমাস আছে, তবুও জম্মুল শেখের কথা শুনিয়া, আলিফ দিন রাত ভাবিতে থাকিলো।
---
আলিফের বাবা জম্মুল শেখ আজি একখানা মোবাইল ফোন ক্রয় করিয়া আনিয়াছে,মোবাইল ফোন দেখিয়া আলিফের ফ্যাকাশে মনমরা চেহেরায় যেন অদ্ভুত এক আলোর বিচ্ছুরণের প্রচেষ্টা। স্কুলের পড়ার সময়ে বন্ধুদের অনেকের হাতে মোবাইল দেখিয়াছে কিন্তুু কখনো ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য তাহার হয় নাই।
বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামিতেছে, অন্ধকার ঘনিয়েও আসিতেছে। মেঘেরা যেন অভিমানের বর্ণ ধারণ করিয়া আছে, মুহূর্তের মধ্যে মেঘেদের অভিমানের বর্ণের শেষ কার্যটুকু প্রকৃতিকে দেখিয়া ছাড়িলো। চারিদিকে শ্রাবণ ধারায় বৃষ্টি পড়িতেছে। আলিফের দৃষ্টিগোচর হইলো, বৃষ্টিতে ঘরের সবাই শান্তির একখানা ঘুমে ব্যস্ত। আলিফ চুপি চুপি জম্মুল শেখের বালিশের নিচ থেকে সদ্য ক্রয়কৃত মোবাইল খানা স্ব হস্তে তুলিয়া নিলো, ইহা পাইয়া যেন- "আকাশের চাঁদখানা হাতে পেলো" এ অবস্হা হইলো। মোবাইলখানা হাতে নিয়া এ বৃষ্টিতে হুমায়ূন আহমেদ'র এর "আজও ঝড়ো ঝড়ো মুখরিত বাদল দিনে" গানটি গায়তে লাগিলো। হঠাৎ মোবাইলে নকিয়া ১১০০ মডেলের সে বিখ্যাত টোনটি বাজিয়া উঠিলো, আলিফের জানাই ছিলো না কিভাবে মোবাইলের কলটা রিসিভ করিয়া কার্য সিদ্ধ করা যায় এ মুহূর্তে। আলিফের মাথায় হঠাৎ স্কুলের হেডমাস্টারের একখানা কথা কানে যেন বাজিতে লাগিলোঃ "লাল সংকেত দিয়া আমরা বিপদজনক চিহ্নিত করিয়া থাকি" তারপরের কথাগুলো আলিফের আর মাথায় আসিলো না। আলিফ ভাবিলো- লাল যদি বিপদজনক হইয়া থাকে তাহলে সবুজ ভালো কিছু হইবো, আলিফ সবুজ বাটন ক্লিক করিলো। ফোনের ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠে বলিতে লাগিলো- হ্যালো হ্যালো! আলিফ হঠাৎ নারী কন্ঠ শুনিয়া স্তব্দ হইয়া গেলো। হ্যালো হ্যালো বলিতে বলিতে লাইনটা কেটে গেলো।
আলিফের বয়স আঠারো। মনস্তাত্ত্বিকদের মতে, এ বয়সে ছেলে-মেয়েদের নতুনত্বের প্রতি একটু বাড়তি আকর্ষণ থাকিয়া থাকে স্বাভাবিক। এ বয়সে হয়তো অসাধ্য কার্যও সিদ্ধ করিয়া পেলে আবেগের উপর চলিয়া থাকা তরুণ-তরুণীরা। এদিকে আলিফের কানে শুধু মিষ্টি মধুর সে কণ্ঠটির সুর যেন বাজিয়া চলিতেছে। শয়নেস্বপনে আজ যেন তারই প্রতিচ্ছবি আঁকার প্রচেষ্টা। প্রতিটি পুরুষ বলিয়া থাকুন নারী বলিয়া থাকুন তাহাদিগরা কিন্তুু একাকীত্বের স্বাদ থেকে বেড়িয়ে এসে যুগল বন্ধী হওয়ার প্রচেষ্টায় অনবরত যুগল বন্ধী ট্রেকে নামিয়া থাকে।
যুগল বন্ধী দৌড়ের ট্রেকে নামিয়া পড়া মনুষ্যকূলের ব্যতিক্রম নহে জম্মুল বেটা আলিফ শেখ। প্রতিদিন রাত ঠিক ১২টা বাজিলে আলিফ অচেনা সে নাম্বারে অত্যন্ত আগ্রহের সহিত কল করিতে থাকিতো। এ যেন তীরহীন দরিয়ায় তরী ঘাটে রাখিবার প্রচেষ্টা। কিন্তুু টানা তিন ধরিয়া কল দিয়াও কোন সাড়া না পাইয়া,সে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় হইয়া পড়িলো। পরের দিন ঠিক ১২টায় সে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসিলো, আলিফের মাথায় ঘুরপাক খাওয়া মেঘের ঘনকটা একটি কলে যেন পরিস্হিতির পরিবর্তন ঘটিলো। ফোনের ওপাশে পুনর্বার অচেনা সে নারীর মিষ্টি মধুর কণ্ঠস্বর। যাহার কণ্ঠ আলিফের ঘুমরাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার গল্প লিখিত হইতে বিঘ্নতা সৃষ্টি করিতেছে এতদিন যাবত, আজ সে মধুর কণ্ঠের সুর আবারো শুনে তাহার হৃদয় মঞ্চিলে যেন একাকীত্বের অবসান ঘটানোর দৌড়ে ট্রেকে নামিয়ে পড়ার আহবান জানাইতেছে। ফোনের ওপাশে নারীর সহিত কিছুক্ষণ ভাব বিনিময়ে অজানা কোন এক রাজ্যে যেন হারিয়ে যাইতে লাগিলো জম্মুল বেটা আলিফ।
আলিফ শেখ আজ জীবনেই প্রথম হয়তো কোন এক অপ্সরার সহিত মুক্ত কথনের যুদ্ধ করিলো।
প্রতিটি ছেলে মেয়েই কিন্তুু জীবনের যেকোন প্রথম কিছুকে আকঁড়ে ধরে রাখিতে চেষ্টারত থাকিয়া থাকে। ইহার মাঝে হয়তো তাহারা তাহাদিগের গুপ্ত কথনের ভালোবাসা পুষ্পমাল্য রচিত করতে চায় বারেবারে। একাকীত্বের স্বাদ থেকে বেড়িয়ে এসে, যুগল বন্ধী হওয়া মাঝে হয়তো মনুষ্যকূলরা জীবনের প্রকৃত সুখ নামক শব্দটিকে হাতড়িয়ে বেড়ায় ! প্রেমিক বলুন প্রেমিকা বলুন প্রতিটি মনুষ্য কিন্তুু তাহাদিগের প্রিয়জনের সম্মুখে নিজেদের স্ব স্বত্বাটাকে প্রকাশ করতে চায়। মাঝ দরিয়ার নাবিকরা যেমনি ঝড়ের প্রতিকূলে স্রোতের বিপরীতে চলা তরীটাকে তীরে আনার নিমিত্তে প্রাণ প্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়, তেমনি প্রতিটি প্রেম-যুগল ভালোবাসার তরীটি নিজেদের করে নিতে চেষ্টা চালিয়ে যায় অহরহ!
ফোনের ওপাশের অচেনা কণ্ঠের সে নারীটা কে হয়তো এখনো জানা নেই আলিফের। আজ সে ভাবিতেছে অচেনা সে নারী কণ্ঠের ললনাটি কি ঠিক একই কথা ভাবিতেছে, হয়তো এ উত্তর জানা নেই তাহার। তবুও তাহার একটি কলের অপেক্ষায় আলিফের ক্লান্ত মন। ভাগ্যদেবতা যদি সাড়া দেয় তাহলে হয়তো তাহার একাকীত্বের আকাশটা যুগলবন্দী হবে। পূর্বাকাশে আজ মেঘেরা হয়তো সূর্য্যের সাথে আড়ি দিয়েছে। নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া দুরন্ত গ্রাম্য বালকটি সারাটি দিন যেন তাহার কথা ভাবিতে লাগিলো। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা, পাখিরাও স্ব স্ব নীড়ের দিকে ছুটে চলিতেছে। রাত যত ঘনিয়ে আসিতেছে- অচেনা কণ্ঠের নাম না জানা বালিকাটির কথা গ্রাম্য বালকের মনে আরও বেশী শিহরণ জাগিয়া তুলিলো। ভাগ্যদেবতা হয়তো আজ তাহার ডাকে সায় দিয়েছে, সে অচেনা নাম্বার থেকে আবারও কল। মিষ্টি মধুর কণ্ঠে তাহাদের দুজনের কথার ট্রেনটা যেন চলিতে লাগিলো, এভাবে প্রতিনিয়ত রাত ১২টা বাজিলে দুজনের কথার ট্রেনটা ছুটে চলে। আস্তে আস্তে তাহাদিগের সম্পর্কটা দৃঢ় হইতে লাগিলো। আলিফ নিজেকে রিসান নামের ভিতরে লুকিয়ে রাখিলো, কাকতালীয়ভাবে ফোনের ওপাশের ললনাটির নামের সহিত রিসান নামের সাদৃশ্য দেখা দিলো। কথার ট্রেনে চলিতে চলিতে আলিফ জানিতে পারিলো অচেনা কণ্ঠের নারীটি রিসা। দুজনে আজ যেন একজন আরেকজনের সহিত কথা না বলিলে থাকিতে পারে না। দুজনে যেন আজ দুজনের না বলা এ সম্পর্কের মাঝে সুখের অমৃয় পান করিতে চায় বারেবারে।
তাহাদিগের না বলা এ সম্পর্কের বয়স আজ তেতাল্লিশ হাজার দুইশত মিনিট অথবা পঁচিশ লক্ষ বিরানব্বই হাজার সেকেন্ড! আজ আলিফের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বের হইয়াছে, আলিফ সাফল্যের সহিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছে।
আজি মাকে জড়িয়ে কান্না করিতেছে, পিচকু। দু'জনের দু'চোখে আজ অশ্রুর বন্যা.......
বিঃদ্রঃ গ্রুপের গল্প প্রতিযোগিতার জন্য গল্পটা লিখছিলাম কিন্তুু নেটওয়ার্ক প্রবলেমের কারণে গল্পটা বারবার পোস্ট দিয়েও পোস্ট হলো না... 
 
Top