আজ আর বাবা নেই
আজ আর বাবা নেই, সেই বকবকানিও নেই। অযথা বকুনি গুলো আজ খুব মিস করছি। আমার এ বিশাল সাম্রাজ্যে বাবাকে না পেয়ে ব্যথিত মন বার বার শূন্যে চেয়ে চেয়ে এক সময় বলছে, "আল্লাহ আমার আব্বাকে ভালো রেখো"
.
.
বি এ পাস করার পর যখন দু'বছর ভবঘুরের মতো কাটাচ্ছি তখনই বাবা বাঁধ সাধলেন। আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার তোড়জোড় শুরু করলেন তিনি। সারাদিন পর যখন বাড়িতে ফিরতাম তখন দুনিয়ার যত বকাবকি আছে শুরু হয়ে যেত। মা শুধু বলত,"তুমি থামো তো, সারাদিন পর ছেলেটা বাড়িতে ফিরল আর এখনি তোমার বকার সময় হলো।"
এভাবেই দিন গুলো কাটছিল। সকালে খেয়ে বেরোনো, দুপুরে হাজিরা দিয়ে লাপাত্তা আর রাতে বকা খেতে খেতে ঘুম। কিন্তু এভাবে আর কতদিন!! একদিন বাবা সত্যিই রেগে গেলেন। রাতের খাবার বন্ধ। কথা একটাই এভাবে বসে বসে খাওয়া চলবে না। কাজ কাম কিছু একটা করতে হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে আমি বাবার ব্যবসায়ে কাল থেকে বসব। কিন্তু বাবা এতে রাজি নন। নিজেকেই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আমি চুপচাপ থাকলাম। যাই হোক না কেন বাড়ি থেকে কোথাও বেরোচ্ছি না।
আরো কিছু দিন কেটে গেল............
.
.
একদিন...... সারাদিন টৈ টৈ করে ঘুরে রাতে সবেমাত্র ভাত নিয়ে বসলাম, বাবা ওমনি বললেন,"বুনো শুয়োর একটা। কোনো কথা কানে যায় না। নির্লজ্জের মতো আমার অন্ন ধ্বংস করছে।"
রাগ করে ভাত না খেয়ে উঠে পড়লাম। নিজের ঘরে দরজা দিতে দিতে বাবার সাথে মায়ের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় কানে আসল। মনে মনে সিদ্ধিন্ত নিলাম, এ বাড়িতে আর একদিনও নয়। ভোর হতেই বাড়ি হতে খালি হাতে বেরিয়ে পড়লাম। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে সন্ধ্যায় খালার বাড়িতে উপস্থিত হলাম।
.
এক, দুই, তিন দিনের দিন মা হাজির। আমাকে দেখেই কেঁদে ফেলল। আমি না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকালাম। রাতে যখন খেতে বসলাম মা অশ্রু সজল নয়নে বলল," বাড়ি চল। তোর বাবা আজ তিন দিন কিছুই খায়নি।"
আমি বললাম, "মিথ্যা কথা, আমি আর ও বাড়িতে ফিরছি না।"
মা বলল," আচ্ছা ঠিক আছে বাড়িতে যেতে হবে না। কিছু তো একটা করবি। আর কতদিন এভাবে পথে পথে ঘুরবি। তোর বাবার কথা তো আর সহ্য হয়না বাবা।"
মায়ের অশ্রুর কাছে পরাজিত হয়ে শেষমেষ বললাম," ঠিক আছে আমি ঢাকা যাবো, আগামী পরশু দিন।"
.
এ দু'দিন আর কাটতে চায় না। চির চেনা এ পরিবেশ আর স্বজন ছেড়ে যেতে মন কেঁদে ওঠে বার বার। কান্না জড়িত হৃদয়ে গালি দিয়ে কতবার যে বাবার গুষ্টি উদ্ধার করলাম তার ইয়াত্তা নেই। চলে যাবো তাই এ দু'দিন খুব ঘোরা ঘুরি করলাম।শৈশবের স্মৃতি গুলো মনে পড়ায় কতবার যে চোখ মুছতে হলো তা সংখ্যায় প্রকাশ যোগ্য নয়। নিজেকে খুব অসহায় লাগল এই ভেবে যে বাবা বেঁচে থাকতেও আজ বাড়িতে আমার কোনো জায়গা নেই।
.
.
বিদায়ের সময় হয়ে এলো। মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাটা ধরে রাখতে পারলাম না। নানা প্রকার উপদেশ দিয়ে মা আমাকে বিদায় দিলো। বাবাকে যখন দেখলাম সব দুঃখ যেন রাগে পরিণত হলো এবার। একটি বারের জন্যও বাবার দিকে তাকাবো না বলে পণ করলাম।
.
.
এখন বাসস্ট্যান্ডে অন্য কোনো আত্মীয় নেই, শুধু আমি আর বাবা।
বাস ছাড়ার সময় হলো। এতক্ষণ বাবার মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখলেও শেষটাতে তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। বাসের সিঁড়িতে উঠতে যাবো এমন সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে বাবা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। সেদিন মায়ের কথা বিশ্বাস না করলেও আজ অবিশ্বাসের কোনো কারণই আর অবিশিষ্ট রইল না। এমন কান্না মানুষ শুধু তার প্রিয়জনের শেষ বিদায়েই কাঁদতে পারে। গত এক বছর ধরে বাবাকে যতটা গালি দিয়েছি তার জন্য মনটা অনুশোচনায় পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বাস ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে তাই বাবা আমাকে কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন," বাবা, বাইরের পরিবেশ বড় কঠিন, একটু সাবধানে থেকো।"
মুখে কিছু বলতে না পেরে শুধু ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে গাড়িতে উঠতে উদ্যত হলাম। সত্যিই নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। জীবনের এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সত্যিই বাবার সেদিনের দুর্ব্যবহার গুলো আমার জীবনের ভিত গড়ে দিয়েছিল। সেগুলো বাবা আমার অকল্যাণ নয় বরং কল্যাণ কামনায় করেছিল।
.
যা হোক বাসের সিঁড়িতে পা দিয়ে বাবার দিকে ফিরে তাকালাম। চোখে চোখ পড়তেই আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না।।।।।
.
.
.
ফয়জুল কবীর