সাহিত্য পরিষদ

আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুরা আশা করি আপনারা ভালো আছেন।
একটু দেরী হলেও নিয়ে আসলাম সাহিত্য আসর ১০৪তম পর্বের ফলাফল নিয়ে। গত পর্ব ছিলো গল্পের আসর আগের তুলনায় এই আসরের গল্পগুলো অনেকটা ভালো হয়েছে। আশা করি সামনে আরো ভালো হবে। আপনারা যারা লিখেননি সামনের পর্ব থেকে লিখবেন।সেরা তিনটি গল্পের লিংক দেয়া হলো। পরিষদের পক্ষ থেকে সেরা তিনজনসহ অংশগ্রহণকারী সকলের জন্য রইলো আন্তরিক শুভেচ্ছা।
-
শুভেচ্ছান্তে,
জয়নব জোনাকি।
এডমিন,
বাংলাদেশ প্রজন্ম সাহিত্য পরিষদ।
-------------
ক্ষুধা (গল্প)
দ্বিপ্রহর পেরিয়েছে সে কবে! ছায়া প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। শিউলির মা রাবেয়া বেগম পিড়িতে বসে দরজায় হেলান দিয়ে আছে। চোখে তার অভাবের ছাপ স্পষ্ট পরিলক্ষিত। বুকের মধ্যে সাহারা। চেহারায় স্ফুট খরা। এই পঙ্গুদেহ তার কাছে এক স্থির পাহাড়সম। দুপুরের খাবার এখনও অনিশ্চিত। জমজ দুই সন্তান ছয়বছরের বেলী ও শফি খাবারের জন্য ছটফট করছে। সকালেও মরিচ দিয়ে অল্প পান্তাভাত জুটেছিলো। পেটে তাই যেনো কালবৈশাখী কিছুক্ষণ পরপর ভাত ভাত বলে হানা দিচ্ছে। "মা ভাত খামু" বাক্যটি প্রায় জিকিরে পরিনত হয়েছে। " একটু ধৈর্য্য ধর বাপ, শিউলি এক্কুনি আইয়া পরবো" এই বাণী শুনে আসছে প্রায় ঘন্টা দুইএক ধরে। সময়ের সাথে ক্ষুধা সমানুপাতিক হারেই বাড়ে। পরিপাকতন্ত্র হজম হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তাই কিছুক্ষণ পর রাবেয়া বেগম তাদের পানি খেতে দেয় এবং সম্ভাব্য খাবারের আশার বাণী শুনাতে থাকে। মানুষ বিপদে পড়লে ধৈর্যহারা হয়ে যায়। সে বুড়ো কিংবা বুদ্ধিমান হোক না কেনো। খুব কম মানুষই এর ব্যতিক্রম। আর এই অবুঝ বাচ্চাদ্বয় তাই খাবারের জন্য বারবার তাগাদা দেয়াতে মায়ের মুখ নি:সৃত কর্কশ ধ্বনির আক্রমনের শিকার হলো। কিন্তু ক্ষুধা না মানে গালিবুলি। তাই তারাও অস্থির প্রায়। ফুল বিক্রির একটা অংশ দিয়ে পলিথিনে কিছু চাল আর পাটশাক নিয়ে তখনই দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির আঙ্গিনায় হাজির হলো শিউলি। হাঁপাতেহাঁপাতে মাকে বললো - " মা আইয়া পরছি, এই লও খাবার"। বলতে দেরী হয়নি তৎক্ষণাত দৌড়ে গিয়ে বেলী পাটশাক আর শফি চাল নিয়ে তাদের মা'কে দেয়। রাবেয়া বেগমের মুখে বিদ্যুৎগতিতে ফুটে উঠলো সূর্যের হাসি। অমাবস্যাতেই পূর্ণিমাতিথি। মরুমনে যেনো তরুর সঞ্চার। সভ্যতা, সংস্কৃতি আর টাকার কাছ থেকে যে যতদূরে তাদের চাহিদাও কম। কারণ তারা এর মর্ম বুঝলেও ধর্ম অনেক আলাদা। পঙ্গু রাবেয়া বেগম খুঁড়িয়েখুঁড়িয়ে যায় চুলার নিকটে। চাল ধুইয়ে চুলায় তুলে দিয়েই শাক কাটতে বসলেন। আল্লাহ হয়তো তার হাত দু'টো একারনেই ভালো রেখেছেন। মাঝেমাঝে ভাবে কেনো সেদিন স্বামীর সাথে মারা গেলো না। পরক্ষণেই সন্তানদের কথা ভেবে ঐসব ভুলে যায়। সাতপাঁচ ভাবতেভাবতেই শাক কাটা শেষ করেছে। ঘরে নেয় পর্যাপ্ত মশলাপাতি। থাকবেই বা কি করে এগুলো তো আর আকাশ থেকে নাযিল হয় না। অভাবও লজ্জা পায় এই দুর্দশা দেখে। একসময় যে বাড়িতে টিভি পর্যন্ত ছিলো আজ কি বেহাল দশা। টিভির কথা একারনেই বলছি শিউলির বাবা রিক্সাচালক হলেও শখিন মানুষ ছিলেন। অবশেষে রান্না শেষ করে রাবেয়া বেগম তার তিনসন্তানকে খাওয়ার জন্য ডাক দিলো। শিউলি হাতমুখ ধুয়ে আসে। বাড়ির মাঝখানে একটা ছেঁড়া মাদুর বিছিয়ে খেতে বসেছে তারা তিনজন। রাবেয়া বেগম তাদের পাশে বসে যেনো পাহারা দিচ্ছে। রাফি এখনও আসেনি। রাবেয়া বেগম খুব দুশ্চিন্তাই আছে। কারণ গত দু'দিন তার টোকাই কাজ ভালো যায়নি। টাকাও পায়নি। তাই হয়তো আসছে না- এটাই তিনি মনে করছে। তার দুশ্চিন্তার আরেকটি কারন ইদানীং ময়লার স্তুপে মাথাকাটা লাশ কিংবা দেহবিহীন মুণ্ডু পাওয়া যাচ্ছে। তাই রাফির অনুপস্থিতি রাবেয়া বেগমকে অস্থির করে তুলেছে। আর ক্ষণিক পরপর বলছে - " আল্লাহই জানে পোলাডা আমার কই "? শিউলি, বেলী আর শফি এমনভাবে ভাত খাচ্ছে যেনো স্বর্গীয় মান্না-সালওয়া খাচ্ছে । রাবেয়া বেগম তাদের ভাত বেড়ে দিচ্ছে। শিউলির অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি খেতে বসলেন না। খাবার শেষ হতে না হতেই আসরের আজান ভেসে আসলো। ভূগোল আকৃতির এই ঘরে আলোবাতাসের মতো শব্দ এমনকি চোরও অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবে। যদিও এঘরে চোরের প্রশ্ন অবান্তর। খাবার শেষ করে শিউলি উঠে দাঁড়াতেই তার চোখ গিয়ে পড়ে হাড়ির দিকে। আর বুঝতে পারে তার মা কেনো তাদের সাথে খেতে বসেনি। বসে কি খাবে? হাড়িতে যে সব পোড়াভাত। রান্নার মাঝখানে লাকড়ি আনতে গিয়ে ভাতের এই অবস্থা!
খোরশেদ মুকুল
১৭-১০-২০১৬ ইং
-----------------
'ল্যাপটপ'
-মাহবুব এ রহমান
- - - - - - -
প্রতিদিনের মতো আজও দ্রুত বেডরুমে চলে গেল আফহাম।
'নাতিটা ইদানিং কেমন যেন হয়ে গেছে। আগের মতো আর তেমন মেশেনা আমার সাথে। গল্প শোনার জন্য বায়নাও ধরেনা আজকাল' আফহামের নিরবে বেডরুমে চলে যাওয়া দেখে এসব ভাবছেন আফহামের দাদুমণি। পুরোনাম তানভির মোরশেদ আফহাম। পড়ে রাজধানীর একটি কেজি স্কুলে।সবে মাত্র ক্লাস ফোরে উঠেছে।বাসায় ওর আম্মু,দাদুমণি আর আব্বু।আগে গ্রামেই থাকতো ওরা। ঢাকায় আসার বছরখানেক হয়েছে। আব্বু চাকরি করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে আর আম্মু প্রাইমারি স্কুলে। আব্বুর ঢাকায় বদলি হওয়ায় চলে আসেন সবাই। আম্মুও ট্রান্সফার হয়ে আসেন রাজধানীর একটি স্কুলে। ক্লাস টু পর্যন্ত গ্রামেই পড়ালেখা করেছে আফহাম। বরাবরই ভালোছাত্র ছিলো সে। কখনো পড়ালেখাতে কেউ তাকে পিছনে ফেলতে পারতো না। সব ক্লাসেই ১ম রোলটা ছিল আফহামের দখলে। গ্রামের আলো-বাতাসে বড়ো হয়েছে ও। গ্রামের বিকেলের চিত্রটা শহরের মতো নত মোটেই।গ্রামে আসরের পর শেষবিকেলে যখন মাথার উপর সূর্যটা ছড়াতো মিষ্টিরোদ। সবুজঘাসে চিকচিক মুচকিহেসে জানান দিতো বিদায় নেওয়ার। তখন রাখালেরা প্রস্তুতি নিতো বাড়ি ফেরার। গাঁয়ের সকল ছেলেরা বেরিয়ে পড়তো মাঠে।
কেউ ফুটবল কেউ ক্রিকেট আর কেউ গোল্লাছুট ইত্যাদি খেলায় মেতে উঠতো সবাই। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার পূর্বেই বাড়ি ফিরতো সবাই। আফহামও মাঠে বেরুতো বিকেলে। আফহামের আম্মু ছেলেকে মাঠে যেতে দিতে চাইতেন না। কিন্তু ওর দাদুমণির বকা দিতেন আম্মুকে। 'ছোটো একটা মানুষ ও। বিকেল হয়েছে একটু মাঠে যাবে, খেলবে, ঘুরবে। তা না করে সারাদিন শুধু পড়া পড়া। এমন করে ছেলেকে একঘেয়ে বানাবে। কারো সাথে মিশতে চাইবেনা পরে। নিজের মতো করে একটু না খেললে, ঘোরলে মানুষের সাথে মিশবে কেমন করে। সামাজিকতা শিখবে কেমনে!' দাদুমণির এমন বকুনিতে আম্মু মাঠে যেতে দিতে বাধ্য হোন।
আফহাম আর ওর বন্ধুরা মাঠের পাশের পুকুর পাড়ে দলবেঁধে গোল্লাছুট খেলতো। কিন্তু শহরে এমন নেই মোটেও। যে দিকে চোখ যায় শুধু যান্ত্রিক ব্যস্ততা। শহরে প্রথম আসার পর মোটেই ভালো লাগতো না আফহামের। চব্বিশ ঘন্টাই চার দেয়ালের ভেতর বন্দী। দাদুমণিই ওর একমাত্র সাথী। মাঝে মাঝে একা একা বাসার ছাদে গিয়ে মনমরা হয়ে বসে থাকতো ও। ছাদে টবের ফুলগাছে প্রজাপতির ওড়াওড়ি দেখতো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নাশতা সেরে আম্মু দিয়ে যান স্কুলে। দুপুর দু'টোয় স্কুল বাস এনে নামিয়ে দিয়ে যায় বাসার নিচে। আম্মুর স্কুল ছুটি হয় বিকেল চারটায়। তাই বাসায় এসে দাদুমণির হাতে খাবার খেয়ে গল্প জুড়তো দাদুমণির সাথে। দাদুমণি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াতেন ওকে। বাসার পাশে ছোট্ট একটু খালি জায়গা। দেখতে ছোটোখাটো একটি মাঠের মতো। বিকেলে বস্তির ছেলেরা বেরুতো ফুটবল নিয়ে। আফহামও যেতে চাইতো কিন্তু ওর আম্মু ওদের সাথে মিশতে দিতেন না ওকে। ধীরেধীরে মিশতে থাকে নতুন স্কুলের বন্ধুদের সাথে। জানতে পারে ওরা প্রত্যেকেই কেউ টিভি দেখে, কেউ ট্যাব অথবা ল্যাপটপে গেম খেলে বিকেলের সময়টা পার করে। তাই আফহাম আব্বুর কাছে বায়না ধরে তাকে একটি ট্যাব কিনে দেওয়ার জন্য। অনেক ভেবেচিন্তে এবং শেষে ওর দাদুমণির কথায় মাঝারি দামের একটি ওয়ালটন ট্যাব কিনে দেন ওকে। প্রতিদিন বিকেলে আসরের পর আম্মু ট্যাব বের করে দিতেন। গেম খেলত আফহাম। আবার সন্ধ্যার আগে নিয়ে নিতেন। এমন করেই চলছিলো। আফহামের ছোটোচাচ্চু আমেরিকায় থাকেন। একদিন ফোনে কথা বলতে আফহামকে বলেন 'শহরে এসেছো। আরো ভালো করে লেখাপড়া করতে হবে। যদি থ্রীতে তোমার ক্লাসে ফার্সট হতে পারো তাহলে একটা ল্যাপটপ পাঠাবো তোমার জন্য' আফহাম আরো মনদিয়ে শুরু করলো লেখাপড়া। বার্ষিক পরীক্ষা এলো। ভালো করে পরীক্ষা দিলো। এবং রীতিমতো অবাক করে দিয়ে ফার্সট হলো আফহাম। গ্রাম থেকে এসে নতুন একটি ছেলের এমন রেজাল্ট! তাই বিস্মিত ও খুশি শিক্ষকরাও। চাচ্চুও কথামতো ল্যাপটপ পাঠালেন আমেরিকা থেকে। আফহামের আম্মু ল্যাপটপটিও আগের মতো বিকেলে একটু ব্যবহার করতে দিতেন।
একদিন আফহাম স্কুল ব্যাগে লুকিয়ে স্কুলে নিয়ে যায় ল্যাপটপটি। বন্ধুদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নতুন নতুন গেম। ল্যাপটপটা রাখা ছিলো বেডরুমেই। ওর আম্মু সিকিউরিটি লক লাগিয়ে রাখতেন। কিন্তু কেমন করে কোডটি জেনে জায় আফহাম। তাই আগের মতো স্কুল থেকে এসে দাদুমণির সাথে গল্প করে ঘুমোয় না। দুপুরের খাবার খেয়ে দ্রুত চলে যায় বেডরুমে। ঘুমের ভান করে ল্যাপটপে পড়ে থাকে গেম নিয়ে। দাদুমণি তেমন খেয়াল করেন না বেডরুমে। ভাবেন ও বড় হচ্ছে, নিজে নিজে ঘুমোতো শিখছে। এভাবে ঘুমকে ফাঁকি দিয়ে গেম খেলে সময় পার করে আফহাম। গেমের প্রতি দারুণ রকমের আসক্ত হয়ে পড়ে। পড়ালেখার প্রতি আগ্রহটা কমতে থাকে দিন দিন। এমন করে চলে আসে ফোরের বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষা দেয় আফহাম। রেজাল্ট বেরুনোর দিন ওর আব্বুও সাথে যান স্কুলে। এবারও ছেলে ফার্সট হবে এই আশায় এসেছিলেন স্কুলে। রেজাল্ট বেরুলো। আফহামের রোল সাত। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো আফহামের আব্বুর। তাকান ওর মুখের দিকে। মনমরা হয়ে ছেলেকে নিয়ে পথ ধরেন বাসার।
---------------------
কৃতকর্ম (ছোটগল্প)
আব্দুর রহিম
.
ধোঁয়াচ্ছন্ন একটা রুমের এক কোণে খালি টেবিলে একা বসে আছে মামুন। বারবার তাকাচ্ছে তার হাতঘড়ির দিকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাগরিবের নামাজ অনেক আগেই পড়েছে। এই অপেক্ষায় অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে সে। তারওপর অন্য তিন টেবিলে লোকজনের গ্যাদারিং আর মাথার উপরে ফ্যানটার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ বিরক্ত করছে তাকে। চোখে শুন্য দৃষ্টি।
.
টেবিলে ‘খট’ করে শব্দ হওয়ায় মামুন বুঝল নেহেরি এসে গেছে। চকিতে ওয়েটারের দিকে তাকালো সে। ওয়েটারও মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বললো- ফার্স্টক্লাস বস। খেয়েই দেখো ! মামুনও রাজ্যের সমস্ত মনোযোগ খাবারের দিকে নিবিষ্ট করতে চাইলো। কিন্তু পরমুহূর্তে মনে হলো এ ছেলেকে সে চেনে ! যেন তার সাথে বহুদিনের সম্পর্ক রয়েছে মামুনের। তাকে জিজ্ঞেস করার জন্য মুখ তুলে দেখে সে চলে গেছে। অপলক দৃষ্টিতে ওয়েটারের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
.
হঠাৎ মামুনের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এখন থেকে ৫ বছর আগের একটা পরিচিত মুখ ভেসে উঠলো তার সামনে। সদা হাস্যোজ্জল আতিক তার এক বছরের জুনিয়র। ক্লাস সিক্সের কথা। আতিক এতিম, মামার কাছে থাকতো আর একটা মাদ্রাসায় পড়ত। সে যেমন মিশুক ছিল তেমনি মামুনও মিশুক। তাই অন্য ক্লাসের হয়েও দুজনের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দুজনে অনেক সময় শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়াত। মামুন যেন স্বচক্ষে দেখছে সেই ইতিহাস ! একদিন আতিক মামুনকে বলল, খুব ক্ষিদে পেয়েছে, চলো দুজনে খেয়ে আসি। মামুন না করতে পারলোনা। গেটম্যানকে ফাঁকি দিয়ে পালাল দুজনে। ঘুরে ঘুরে জেলা স্কুলের সামনে চটপটিওয়ালার কাছে থামলো। এতক্ষণ নানা গল্প করেছে তারা। আতিক দুজনের জন্য চটপটি নিল। খেতে খেতে বলল, মামুন ! এ কয়দিনে আমার অনেক কলম হারিয়েছে। এজন্য মামার কাছে বকা খেয়েছি। কিন্তু আজকে যে কলমটা হারাল সেটা মামা রেজাল্টের দিন গিফট করেছিল। অনেক দামি।
.
কোন শালা যে চুরি করছে ! এর আগের কলমগুলো একটাও পাইনি কিন্তু এটা না পেলে আর ক্লাসে আসবোনা।
সেদিন মামুন কিছু বলতে পারেনি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল শুধু। কি বলবে তাকে ! তার কলম খোয়ানোর কারন অন্য কেউ নয়, মামুনই।
তার মাসখানেক আগের কথাও মনে পড়ল মামুনের। বিকালে প্রাইভেট টিউটরের রুমে মামুন সহ ফাইভের কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছে। আসলে অংক করতে দিয়ে স্যার গেছে নামাজ পড়তে। অংক করছে আর হাবিজাবি গল্পে মেতে আছে ওরা। ফাইভের জীবন মামুনকে বলল-
: তোমাকে একটা কাজ দিব। করে দিবে ?
: কি কাজ ?
: এই একজনের কলম লুকিয়ে ফেলতে হবে।
: কলম ? এটা কোন ব্যাপার হলো ??
: করবে তাহলে ?
: হ্যা, কিন্তু কার ?
: নিপুনের।
: তোমারই তো বন্ধু !!
: হ্যা, কিন্তু শালাকে মজা দেখাব ! খুব বেড়ে গেছে। স্যার অংক করতে দিলে ওর কলম থাকবেনা। আর আমরা ওকে কলম দিবনা। স্যার সাইজ করে দিবে ওকে।
: ঠিক আছে। দেখে নিও, কয়েকদিন ওর ব্যাগে কোন কলমই থাকবেনা !
পরদিন তাই হলো। নিপুন কলম খুঁজে পেলনা। এই মুহুর্তে তাকে কেউ সাহায্য করলনা। ৫-৬ দিন এমন হওয়াতে অংক স্যার খুব ক্ষেপে গেলেন। ‘আমার সাথে ইয়ার্কি হচ্ছে ??’ ‘কলম না এনে মজা কর আমার সাথে ??’ দুইটা থাপ্পড় দিয়েছিলেন স্যার। শুধু অংক স্যার না অন্যান্য স্যাররাও তার ওপর ক্ষেপে গেছে। এভাবে চলছিল। কিন্তু এতেই শেষ না। কলম চুরিতে মামুনের হাত পাকা হয়ে গেছে ! নিপুনের কলম তো আছেই মাঝে মাঝে অন্য ছাত্ররাও কলম আর পায়না ! একদিন হলো কি ! নিপুনের ব্যাগ থেকে কলমের সাথে ৫০ টাকাও লুকিয়ে নিল মামুন। কিছুক্ষণ পর নিপুন কাঁদতে কাঁদতে এদিক ওদিক ঘুরছে। মামুন তাকে বলল-
: কি হয়েছে নিপুন ?
: আমার টাকা কে চুরি করেছে !
নিপুনের অশ্রুসজল চোখ দেখে মামুন খুব ব্যাথা পেল ! এ সে কি করেছে !! দুদিন আগে নিপুন এক ক্লাসমেটের কাছে টাকাটা ধার নিয়েছিল।
.
আজ ফেরত না দিলে তারা কয়েকজন মিলে খুব মারবে তাকে। পিরিয়ড শেষে অতি সন্তর্পণে মামুন টাকাটা তার ব্যাগে রেখে চলে এসেছিল। সেদিনই চুরি করেছিল আতিকের কলমটা। সেটা নিতে চায়নি কিন্তু দামি কলম হওয়ায় লোভ সামলাতে পারেনি।
.
তারপরে আর আতিককে কলমটা দিতে পারেনি মামুন। তাকে না জানিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এ সুযোগ আর পেলনা ! আতিকের ক্লাস আসা বন্ধ হয়ে গেল। দু' সপ্তাহ পর জানতে পারল আতিক খুব অসুস্থ।
সে হতাশ হয়ে গেল ! আতিকের কথা কি সত্যি হল ? আর আসবেনা ক্লাসে ? দেখা হবেনা কোনদিন ?
.
কিন্তু আজ আতিককে সামনাসামনি দেখে খুব লজ্জা করছে মামুনের। পরিচয় দিতেও মন সায় দিচ্ছেনা। যেন তার কৃতকর্ম তাকে পরিচয় দিতে বাঁধা দিচ্ছে ! খাবার শেষে উঠে দাঁড়ালো মামুন। বিল পরিশোধ করে বেরিয়ে গেল হোটেল থেকে।
 
Top