'বাবার চোখে জল'
.রিদওয়ান হোসাইন
তখন খুব রাত।আমি বাবার সঙ্গে হাটছি।বাবা পেস্ট কালারের একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছেন।এই পাঞ্জাবিটা আমি ছোট বেলায় পরতে দেখেছিলাম।তখন সেটা খুবই ঝকঝকে ছিলো।এখন রং হারিয়ে মলিন।এখানে ওখানে ফেঁসে ফেটে গেছে।বাবা ভালো সেলাই জানেন।খুব সূক্ষ্ম ভাবে সেলাতে গিয়েও ফাঁস গুলো লুকানো যায়নি।কলারের ফাঁসটা খুবই বিশ্রী লাগছে।সেদিকে বাবার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।তিনি এক নাগাড়ে কথা বলেই যাচ্ছেন।এবার বললেন-
-তোর কি মনে পড়ে সেই পুরনো দিনের কথা..?তখন তুই ছোট ছিলি.।
-নাহ্,মনে পড়েনা।ওসব নিয়ে ভাবিনা।
-কেনো ভাবিসনা?ইচ্ছে করেই..?
-সেদিনের বাবার সাথে তোমার কোনো মিল নেই।তোমার অনেক অবনতি হয়েছে।তুমি পঁচে গেছো বাবা..!
বাবা আমার কথায় কিছু মনে করলেননা।কিছু মনে করার শক্তিটা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।খুঁজে নেবার আগ্রহ নেই আর।বাবা এখন অবহেলিত।তাঁকে নিয়মিত অবহেলা করাহয়।চূড়ান্ত ভাবে অবহেলিত হতে হতে এই ব্যাপারটা তিনি মেনে নিয়েছেন।
এখনো বাবা হাটছেন।শহরের পথঘাট গুলো সব একইরকম দেখতে।তাই পরচিত ঠেকলেও ঠিক কোথায় হাঁটছি বলা যাচ্ছেনা।দোকানপাট সব বন্ধ।জন মানুষের চিহ্ন নেই।মনে হচ্ছে আজ রাতে এই পথ আমাদের হাঁটার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।সঙ্গি কেবল ল্যম্প পোষ্টের মরতে বসা আলো আর এই রাত।বাবা হাটছেন।বাবা খুব ভালো হাটেন।আমি বারবার পিছে পড়ে যাচ্ছি।এগিয়ে গিয়ে তাল মেলাবার আগ্রহ না দেখে বাবাই থেমে থেমে তাল মিলাচ্ছেন।হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থামলাম।রেস্টুরেন্টটা খুবই পুরনো।শ্রীহীন।তবে এককালে এটি খুব অভিজাত রেস্টুরেন্ট ছিলো।এখন ভগ্ন দশায় পড়ে আছে অনেক বছর।এখন বুঝা গেলো,আমরা শ্যামলি আছি।খুব আশ্চর্য হলাম,এটা কেউ চালায়না।অন্য কোনো দোকানও হয়নি।শহরে কোনো পাবলিক টয়লেট পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে থাকলে স্থানীয় কোনো ক্ষমতাধর সেটা দখল করে নিবে।এটা নিয়ম।তারপর সেটা ভাড়া দেওয়া হবে।দোকানের নাম হবে,"সুগন্ধি শাহী পান বিতান"।কিন্তু এটার বেলায় তেমন ঘটেনি।রেস্টুরেন্টের দরজা খোলা আছে।বাবা ভেতরে ঢুকে গেছেন।আমিও ঢুকলাম।চেয়ার টেবিল সব সাজানো।প্রায় সবই ভাঙ্গা,ধুলো জড়ানো।মাকড়সাদের উত্তম আবাস।বাবা ভালো দেখে দুটো চেয়ার বাছাই করলেন।তারপর নিজ হাতে পরিষ্কার করে একটা ভালো টেবিলে সাজালেন।আমরা দুজন মুখোমুখি বসলাম।বাবা কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন,"এখানে তুই আরেকবার এসেছিলি।"
আমি নির্বিকার ভাবে বলে দিলাম,-আমার মনে আছে..।
.
তখন আমি ছোট।বাবার সাথে প্রথম শহরে এসেছি।প্রতিদিন বাবা একেক যায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেতেন।আমার সবচে আগ্রহ ছিলো,লিফ্টে চড়ে উঁচু দালানে ওঠা।একদিন বাবা এই রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলেন।কত রকম খাবারের লোভনীয় গন্ধ পেয়েছিলাম সেদিন!ভুলে যাইনি। বাবা আমাকে বলেছিলেন,কি খাবে আব্বু..?তুমি যেটা ইচ্ছে অর্ডার করো।যত গুলো খাবার পছন্দ সব নাও।এখানে না খেতে পারলে বাসায় নিয়ে খাবে।আমার সব মনে আছে..
বাবা বললেন,নিজের হাতে অনেক কিছু খেয়েছিলি তুই।আমি খুব খুশি হয়ে ছিলাম।তোকে জোর করেও কিছু খাওয়ানো যেতো না।মনে আছে তোর..?
আমি বললাম হ্যাঁ,আমার মনে আছে।
-সেদিনও আমি তোর বাবা ছিলাম।তবে আমার পিতৃত্বে পঁচন ছিলোনা।আমার তখন অনেক টাকা পয়সা ছিলো।তোদের চাহিদা মত আমি খরচ করতাম।আমরা সবাই দামি পোষাক পরতাম।মনে আছে তোর..?মনে আছে আমাদেরবাড়ীর কথা..?খুব বড়..!
-হ্যাঁ,মনে আছে।আমার মনে আছে।এখন আর সেই বাড়ী নেই।দামি জামা গুলো শুধু তোমার কাছেই আছে।সেলাই করে যা অবস্থা করেছো..!কাউকে বলতে যেওনা আবার,এক কালে দামি ছিলো।
-আমার সব আত্মিয় পরিচিতজন আমার পাশে ছিলো।দূরে থাকেনি কেউ।তারপর যখন আমার বিপদ দেখা দিলো।খারাপ সময় আসি আসি করছিলো।তখন সবাই কতো তড়িগড়ি করে দূরে চলে গেলো।ভালো হয়েছে।খারাপ সময়ে আমার পাশে থেকে কারো কষ্ট করতে হয়নি।তোর নিশ্চই সব মনে আছে..?
-হ্যাঁ,আমার মনে আছে।তুমি খুব একটা ভালো বংশে জন্ম নাওনি।
-আমার এখন ছোট্ট সামান্য একটা চাকরি।এতো অল্প বেতনে হবেনা।তোদের কথা ভেবে আমি টিউশনি করি।দুপুর থেকে শুরু হয়,রাত দশটায় গিয়ে শেষ।বিশ্রাম আমার ভাগ্যে নেই।সপ্তাহে একটা দিনই যা।আমার ষ্ট্রোক হওয়ার পর 'আই সি ইউ' বেডে এক সপ্তাহ লম্বা-চওড়া বিশ্রাম হয়ে ছিলো।রিলিজ হওয়ার পর ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে আবারো শুরু করি টিউশনি।আমার জন্য নয়।চার তলা পাঁচ তলা বিল্ডিং বেয়ে পড়ানোর কষ্ট তোদের মুখের দিকে চেয়ে করি।এটা নিশ্চই নিত্য নিত্য ভুলে যাসনা..?
আমি বললাম,না।ভুলিনা।
বাবা এবার একটু থামলেন।মনে হচ্ছে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছেন।।দুই গ্লাস ঠান্ডা পানি চাইলেন।এই পরিত্যাক্ত রেস্টুরেন্টে বাবা কার কাছে পানি চাইলেন বুঝা গেলোনা।তবে একটা লোক এসে পানি দিয়ে গেলো।লোকটাকে চেনা যাচ্ছেনা।অবয়বটা দেখছি শুধু।একবার মনে হচ্ছে আমি।আবার মনে হচ্ছে বাবা। আবার আমি..।দূর থেকে কে যেনো ডাকছে আমাকে।একটা নারী কন্ঠ।কন্ঠটা আমি চিনি।খুব চেনা..।ডাকার মাঝে আবছা আবছা কি যেনো বলছে।চারপাশ ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে উঠছে।রেস্টুরেন্টের নামটা পড়া যাচ্ছেনা এখন।বাবার পানি খাওয়া শেষ।তিনি আবার শুরু করলেন,-বুঝলি,আমি এতো কষ্ট করেও তোদের সুখ এনে দিতে পারছিনা।এজন্য আমি অবহেলিত।তোদের থাকার জন্য কোনো যায়গা নেই।ভালো খাবার নেই।ভালো পোষাক নেই।তাই আমি পঁচে গেছি...
বাবা বলেই যাচ্ছেন।আমি সব কথা বুঝতে পারছিনা।মনে হচ্ছে কথা গুলো খুব দূর থেকে ভেসে আসছে।দূরত্বটা ক্রমশ বৃদ্ধিপাচ্ছে।বাবার মুখটা এখন চেনা যাচ্ছেনা।একবার মনে হচ্ছে বাবা।আবার মনে হচ্ছে আমি।আবার বাবা..।আবার আমাকে দূর থেকে ডাকা হচ্ছে।আবারো..।আমার সাথে এসব বাস্তবে ঘটছেনা।এসব আমি স্বপ্নে দেখছি।ব্যাপারটা এখন বুঝতে পারছি।ঘুমটা এখনি ভেঙে যাবে।আমি বললাম,বাবা আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।স্বপ্নটা ভেঙে যাবে।বাবা বললেন,না না না.।তুই স্বপ্ন দেখছিসনা আব্বু।সব বাস্তব।সব সত্যি।জানিস,আমার খুব কষ্ট।তুই আমার কথার উত্তর দিয়ে যা।আমার এতো কষ্টের কি কোনো মূল্য নেই,বল..?
আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিনা বাবা।তুমি এতো দূর থেকে বলছো কেনো..?কাছে এসো।আমি তোমার সব কথা শুনবো।
কন্ঠটা আমায় ডাকছে।
ওইতো,আবারো ডাকছে।বাবা,আমার স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে...।
না....।তুই একবার বলে যা।তোর বাবা কি পঁচে গেছে..?আমি কি পঁচে গেছি...?তোর বাবা.....
কথা গুলো দূরে মিলিয়ে গেলো।আমি জেগে গেলাম।মা এতক্ষণ ডেকে ডেকে খুব বিরক্ত হয়েছেন। এখন বকাঝকা পর্ব চলছে।আমার এতো গভীর ঘুমকে অভিশাপ দিচ্ছেন।আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে মনে হলো।গালে আসতেই মুছে ফেললাম।বাবা ঘুমাচ্ছেন আমার পাশেই।তাকিয়ে দেখি বাবার চোখে জল।বাবা কাঁদছেন.....।
(১৪-১০-২০১৭)