বাংলা ভাষার দুই মহান কবির একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্যজন কাজী নজরুল ইসলাম। কালের বিবর্তনে বাংলা নামের ভূখণ্ডটি খণ্ডিত হয়েছে সেই ১৯৪৭ সালে।
এর একাংশ পশ্চিমবঙ্গ পড়েছে ভারতে। পূর্ববঙ্গ পরিণত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে শেষোক্ত অংশটি বাঙালি জাতির স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভঙ্গের ঘটনা ছিল বেদনাদায়ক। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনিবার্য ফল। বিবেকবান কোনো বাঙালি এ বিভাজনকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। পঞ্চাশের দশকে অন্নদা শঙ্কর লিখেছিলেন— ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল,/ আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে,/ ভাগ হয়নি ক’ নজরুল/ এই ভুলটুকু বেঁচে থাক। / বাঙালি বলতে একজন আছে,/ দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক। ’/
বাংলা ভাষার দুই মহান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের প্রথমোক্ত জন আমাদের জাতীয় সংগীতের কবি, শেষোক্ত জন আমাদের জাতীয় কবি। রবীন্দ্র ভুবনের বাইরে বাংলা কাব্য সাহিত্যে যারা আপন ভুবন তৈরিতে সাফল্য দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে নজরুল সেরা হলেও একই সঙ্গে তিনি ছিলেন পা থেকে মাথা পর্যন্ত এক রবীন্দ্রভক্ত। কবিগুরুর প্রতি ছিল তার অসামান্য শ্রদ্ধাবোধ। তেমনি নজরুলের প্রতি কবিগুরুর স্নেহ ছিল আমৃত্যু বহমান। সুস্পষ্ট স্বতন্ত্র ধারার কাব্য সাধনায় নজরুল অসামান্য কৃতিত্ব দেখালেও তিনি আইকন হিসেবে বেছে নেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। নজরুল করাচি সেনানিবাসে থাকতে “সবুজপত্র’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকায় লেখা পাঠান। স্বনামখ্যাত সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী নজরুলের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রবল প্রভাব থাকায় তা ছাপাতে অস্বীকার করেন। নজরুল পরবর্তীতে প্রচলিত ধারার বাইরে কাব্য সাধনায় কৃতিত্ব দেখান। কিন্তু তিনি কবিতায় যেভাবে তার বিদ্রোহী মনোভাবের প্রতিফলন ঘটান তা অনেকেরই গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মুসলমানদের একাংশের কাছে তিনি বিবেচিত হন ধর্মদ্রোহী হিসেবে। হিন্দু ধর্মান্ধদের গাত্রদাহের লক্ষ্যেও পরিণত হন তিনি। সমকালীন কবিদের কেউ কেউ নজরুলকে কবি হিসেবে স্বীকার করতে কার্পণ্য দেখান। বাংলা কবিতাকে নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে নেওয়াকে তারা চরম আপত্তির চোখে দেখেন।
সংকীর্ণমনাদের এ নজরুলবিরোধিতাকে ভর্ত্সনা জানাতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এগিয়ে আসেন। তিনি তার বসন্ত নাটিকা উৎসর্গ করেন বাংলা কাব্যজগতের এ নতুন প্রতিভার নামে। নজরুলের নামে রবীন্দ্রনাথের বই উৎসর্গের ঘটনা নানাদিক থেকে তাত্পর্যপূর্ণ। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ তখন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে বিশ্বজুড়ে নন্দিত। বাংলা সাহিত্যের অথরিটি হিসেবে তার স্বীকৃতি তখন প্রশ্নাতীত। বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল হিসেবেও তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
অন্যদিকে নজরুল তখন নবীন কবি। কবিগুরু যখন তার বসন্ত নাটিকা বইটি উৎসর্গ করেন তখন বিদ্রোহী কবি জেলে। এ ঘটনা নজরুল সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেয়। কবিগুরু যাকে নিজের বই উৎসর্গ করেন তিনি যে অসামান্য প্রতিভাধর এ সত্যটি প্রকারান্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর রাজনৈতিক তাত্পর্যও ছিল ব্যাপক। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ যাকে তার বই উৎসর্গ করেছেন তেমন একজন কবিকে জেলে রাখাও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের জন্য কিছুটা হলেও বিব্রতকর বলে বিবেচিত হয়।
কবি হিসেবে নজরুলকে প্রতিষ্ঠিত করা ও অপসমালোচনার তীর ঠেকাতেই যে তাকে বসন্ত গীতিনাট্যটি উৎসর্গ করা হয় তা কবিগুরুর বক্তব্যেও স্পষ্ট হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘নজরুলকে আমি গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি। জানি, তোমাদের মধ্যে যারা এটা অনুমোদন করতে পারেনি, আমার বিশ্বাস তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এ মনোভাব পোষণ করেছে। আজ আমি যদি তরুণ হতাম তাহলে আমার কলমেও ওই সুর থাকত। ’
১৯২৩ সালে নজরুলকে যখন রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত নাটিকাটি উৎসর্গ করেন তখন বিদ্রোহী কবি আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এ ঘটনার অনুপম বর্ণনা দিয়েছেন তার স্মৃতিচারণমূলক লেখায়। বিদ্রোহী কবির ওই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দেওয়া তথ্যমতে, বসন্ত নাটিকার উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল— ‘শ্রীমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু’। তিনি লিখেছেন, ‘আমি প্যাকেট খুলে গুরুদেবের উৎসর্গপত্র দেখাতেই নজরুল লাফ দিয়ে পড়ল লোহার গারদগুলোর ওপর। বন্দীর প্রবল উত্তেজনা লক্ষ্য করে ইউরোপীয় ওয়ার্ডার কারণ জানতে চাইলে আমি বললাম, ‘পোয়েট ট্যাগোর ওকে একখানা বই ডেডিকেট করেছেন। ’ সাহেব আমার ইংরেজির ভুল ধরে বললেন, ‘ইউ মিন প্রেজেনটেড?’ আমি জোর দিয়ে বললাম, ‘নো ডেডিকেটেড’। সাহেবের মুখ বিস্ময়াভিভূত— ‘ইউ মিন দি কনভিক্ট ইজ সাচ অ্যান ইম্পরট্যান্ট পারসন?’ আমি বললাম, ‘ইয়েস আওয়ার গ্রেটেস্ট পয়েট নেক্সট টু ট্যাগোর। ’ নজরুল বয়সে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ৩৮ বছরের ছোট। ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি যখন নোবেল পুরস্কার পান তখন নজরুল মাত্র ১৪ বছরের কিশোর। ১৯২২ সালে বিশ্বকবি কারাবন্দী নজরুলকে যখন বসন্ত নাটিকাটি উৎসর্গ করেন তখন তার বয়স মাত্র ২৩। আমাদের এ যুগেও কোনো প্রবীণ কবি ওই বয়সের একজন নবীন কবিকে তার বই উৎসর্গ করতেন কিনা সন্দেহ। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের অসামান্য প্রতিভা স্বীকার করার ক্ষেত্রে সে ঔদার্য দেখান তার কোনো তুলনাই নেই। বন্দী নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ তার বই উৎসর্গ করেছেন এ ঘটনা বিদ্রোহী কবিকে উদ্বেলিত করে। এটি ছিল তার কাছে মহান কিছু অর্জন। তবে নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের স্নেহের শুরু আরও অনেক আগে। ১৯২২ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ধূমকেতু পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু’ সম্বোধন করে আট লাইনের একটি কবিতা লিখে পাঠান। কবিতাটি হলো— ‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। /অলক্ষণের তিলক রেখা/রাতের ভালে হোক না লেখা,/ জাগিয়ে দেরে চমক মেরে/আছে যারা অর্ধচেতন। ’
ধূমকেতু প্রকাশকে অভিনন্দিত করে কবিগুরু সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামকে উৎসাহিত করেন। অর্ধচেতন সমাজকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে নজরুলের অবদানকে প্রশংসার চোখে দেখতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন শোষিত ও নিপীড়িত জাতির মুক্তি সংগ্রামে নজরুলের প্রয়োজন রয়েছে। যে কারণে চারদিকে তীব্র বিরোধিতা যখন নজরুলের অগ্রযাত্রাকে কণ্টকিত করছিল তখন তার প্রতি সহমর্মিতা দেখানোকে তিনি কর্তব্য বলে ভেবেছেন। ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহী কবিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে গ্রেফতার করে। হুগলি জেলে থাকাকালে তিনি বন্দীদের প্রতি কারা কর্তৃপক্ষের নির্যাতনমূলক আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। বন্দীদের প্রতি মানবিক আচরণের দাবিতে অনশন শুরু করেন নজরুল। কারা কর্তৃপক্ষ শত চেষ্টা চালিয়েও নজরুলের অনশন ভাঙাতে পারেনি। বিদ্রোহী কবির জীবন নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। খবর পেয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেন কবিগুরু। তিনি শিলং থেকে টেলিগ্রাম পাঠান বিদ্রোহী কবির কাছে। অনশন ভঙ্গের অনুরোধ জানান। টেলিগ্রামে লেখা ছিল ‘Give up hunger strike, our literature claims you’. কবিগুরু নজরুলকে তার এ বার্তা পাঠিয়ে জানিয়ে দেন, বাংলা সাহিত্যের জন্যই তাকে বেঁচে থাকতে হবে। তিনি যে এ সাহিত্যের অন্যতম সেরা উত্তরাধিকার সেটি স্বীকৃতি হয় মাত্র এক লাইনের ওই বার্তায়।
রবীন্দ্রযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। নজরুলও এ কবির ভক্ত ছিলেন। ওই সময়ের স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক গজেন্দ্র ঘোষের বাসায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। নজরুল এ সময় দত্তকে দেখে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। বলেন, বহুদিন থেকেই আপনার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নজরুলকে স্নেহের সুরে বলেন, ‘তুমি ভাই নতুন ঢেউ এনেছ। আমরা তো নগণ্য; গুরুদেবকে পর্যন্ত বিস্মিত করেছ তুমি। ’ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্নেহাপাশে আবদ্ধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ অসামান্য প্রতিভার কোনো অপচয় হোক তা তিনি চাননি। নজরুলকে নিয়ে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না। নজরুল জীবিকার প্রয়োজনে এতই ব্যস্ত থাকতেন যে, কখনো কখনো শুধু টাকার জন্যই লিখতেন। একবার তিনি স্নেহভাজন কবিকে কাছে পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘শুনেছি তুমি নাকি মন জোগানো লেখা লিখতে শুরু করেছ। বিধাতা তোমাকে পাঠিয়েছেন তলোয়ার হাতে। সে তলোয়ার দিয়ে তিনি কি পাঠিয়েছেন দাড়ি চাঁছবার জন্য?’
সুমন পালিত, লেখক : সাংবাদিক।
(বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৬/০৮/২০১৭)