দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের'সোনার তরী' কাব্যের প্রথম কবিতা 'সোনার তরী' লেখা হয়েছিল বাংলা ১২৯৮ সনের ফাল্গুন মাসে, আর শেষ কবিতা 'নিরুদ্দেশ যাত্রা'র রচনাকাল ২৭ অগ্রহায়ণ, ১৩০০ বঙ্গাব্দ। অর্থাৎ গোটা 'সোনার তরী' কাব্যটি কবির ৩০-৩২ বছর বয়সের রচনা। তাঁর আগেকার কাব্যগুলো থেকে 'সোনার তরী' যে 'একটি বিশিষ্ট অবস্থায় উপনীত হয়েছে'_ অ্যাকাডেমিক রবীন্দ্র গবেষকদের অনেকেই তা লক্ষ্য করেছেন। জগৎ ও জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসাই 'সোনার তরী' কাব্যের মূল সুর_ এ সত্যও তাঁদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে। এ রকম পর্যবেক্ষণের যথার্থতা আমরা অবশ্যই অস্বীকার করতে পারি না। কবি জগৎকে শুধু গভীরভাবে ভালোই বাসেননি, এর সঙ্গে তিনি আক্ষরিক অর্থেই একাত্ম হয়ে পড়েছেন। কোনো অবাস্তব কল্পলোকে নয়, প্রকৃতির বিচিত্র প্রকাশ ও মানবজীবনের বিকাশের মধ্যেই বিশ্বসৌন্দর্যকে অনুভব করতে হবে_ 'সোনার তরী'র সব কটি কবিতার ছত্রে ছত্রে এ সত্যটিই পরিস্ফুট। অবাস্তব কল্পসৌন্দর্যের প্রতি বিরূপতার তীব্র প্রকাশ দেখতে পাই রূপকাশ্রয়ী 'পরশ পাথর' ও 'আকাশের চাঁদ' কবিতায়। 'বৈষ্ণব কবিতা' শিরোনামে যে কবিতাটি 'সোনার তরী' কাব্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তা তো কবিতা নয় শুধু, কবিতার আধারে নতুন এক বাস্তববাদী কাব্যতত্ত্বও। 'শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান'_ এমন কথা নির্বিবাদে মেনে নিতে কবির অন্তর সায় দেয়নি। পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান-অভিমান প্রভৃতি কেবল দেব-লীলাতেই সম্ভব, বৈষ্ণব মহাজন কবির উত্তরসূরি কবি রবীন্দ্রনাথের বিবেচনায় এ দাবি অগ্রাহ্য। তিনি মনে করেন : বৈষ্ণব কবিরা রাধা-কৃষ্ণের যবনিকান্তরালে এই মর্ত্যের মানব-মানবীর পারস্পরিক আকর্ষণজাত প্রেমের কথাই ব্যক্ত করেছেন, স্বর্গীয় বা অপার্থিব প্রেমের ধারণা জাগতিক মানবীয় প্রেমের দৃষ্টান্ত থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে, মর্ত্যের মানব-মানবীর প্রেমের ছায়াপাত ঘটেছে বলেই বৈষ্ণব কবিতা আমাদের কাছে এত মনোহারি হয়ে উঠেছে। বৈষ্ণব কবিতার এরূপ নতুন ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথের মর্ত্যপ্রেম ও মানব-প্রীতিরই স্বাক্ষর। জগতের প্রতি কবির ভালোবাসা যে কত গভীর, তারই অন্যরকম প্রকাশ 'যেতে নাহি দিব' কবিতায়। জগতের সবকিছুই নশ্বর, কিছুই এখানে চিরস্থায়ী নয়। তবু মানুষ এই পৃথিবীর স্নেহ-প্রেম ছেড়ে যেতে চায় না। 'চারি বছরের কন্যাটি'র মুখের 'যেতে নাহি দিব' কথাটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে এক করুণ ক্রন্দন-ধ্বনি শুনতে পেয়েছেন কবি। যে ক্রন্দন কবির মধ্যেও এক প্রবল প্রতিরোধশক্তি জাগিয়ে দিয়েছে, জগতের প্রতি আকর্ষণকে আরো গভীর করে তুলেছে। 'সমুদ্রের প্রতি' ও 'বসুন্ধরা' কবিতা দুটিতে কবির এই মর্ত্যপ্রীতি আরো অনেক বেশি মুগ্ধতা ও আকুলতার সঙ্গে ফুটে উঠেছে। সমুদ্রকে তিনি সম্বোধন করেছেন 'আদি জননী সিন্ধু' বলে। সমুদ্র থেকেই বসুন্ধরার উদ্ভব_ এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে কবির কল্পনা উদ্বুদ্ধ ও আলোড়িত। এ ভাবটি আরো গভীর হয়েছে 'বসুন্ধরা' কবিতায়। পৃথিবীকে একান্তভাবে ভালোবাসতে পেরেছেন বলেই এর সর্বত্র নিজেকে ব্যাপ্ত করে বিলিয়ে দেয়ার জন্য তার আকুলতা। বিজ্ঞানীর বাস্তব সত্য কবির অন্তর সত্যে পরিণত হয়ে কবিতাটির মধ্যে একটি বিশেষ গতিবেগের সঞ্চার হয়েছে এবং জগৎ ও মানবপ্রীতির পরিচয় পরিস্ফুট করে তুলেছে। কিন্তু, শুধু প্রথাবদ্ধ অ্যাকাডেমিক ব্যাখ্যায় 'সোনার তরী' কাব্যের মূল মর্মটিকে স্পর্শ করতে পারা যাবে বলে মনে হয় না। 'সোনার তরী' রচনার সময় রবীন্দ্রনাথ জমিদারি তদারক করতে পদ্মাপারের জনপদে ঘুরেছেন, মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে মিশেছেন, নিসর্গ প্রকৃতি ও মানব-প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয়ে যুক্ত হয়েছেন এবং এসবেরই ফলে জগৎ ও জীবনের প্রতি এ রকম গভীর ভালোবাসার কবিতাগুলো তার হাত দিয়ে বেরিয়ে এসেছে_ এমন বক্তব্যের পক্ষে সমালোচকরা রবীন্দ্রনাথের সাক্ষ্য হাজির করেছেন। কেউ কেউ এ সময়কার লেখা তার পত্রাবলী ও ছোট গল্পগুলোর প্রসঙ্গ তুলেছেন। তবু অ্যাকাডেমিক সমালোচনা রবীন্দ্র-মানস বিশ্লেষণের গভীরে যেতে পারেনি। কাব্যগ্রন্থের নাম-কবিতা 'সোনার তরী'-কে নিয়ে বাগ্বিত-ার ঝড় উঠেছিল যখন, তখন ভক্ত সমালোচকরা কবিতাটির অর্থ উদ্ধারের জন্য স্বয়ং কবির কাছেই ধরনা দিয়েছেন। কবির দেয়া ব্যাখ্যাকেই মোটামুটি মেনে নিয়ে তারা এ কবিতার রূপকার্থ বিশ্লেষণ করেছেন। বলেছেন : সোনার তরী হচ্ছে বিশ্বের চিরন্তন অখ- ও আদর্শ সৌন্দর্যের প্রতীক, এর মাঝি হলো সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, আর নদী_ কাল প্রবাহ, কৃষক_ মানুষ, ক্ষেত্র_ জীবনের ভোগবহুল কর্মক্ষেত্র, ধান_ খ- সৌন্দর্যের সঞ্চয়। আবার 'সোনার তরী'র রবীন্দ্র-কৃত আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও কম হয়নি। এ অবস্থায়, একসময় অ্যাকাডেমিক প্রথাবহির্ভূত সমালোচনায় বাঙালি মার্কসবাদীরা এগিয়ে এসেছিলেন দ্বান্দ্বিক রীতি-পদ্ধতি নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে, বাংলা ১৩৫৩ সনের শারদীয় সংখ্যা 'পরিচয়' পত্রিকায়, বিশিষ্ট মার্কসবাদী সাহিত্যতত্ত্ববিদ অধ্যাপক নীরেন্দ্রনাথ রায় 'সোনার তরী' প্রসঙ্গে লিখেছেন_
"... রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রতিভা তাঁহাকে তাঁহার সামাজিক কর্তব্য হইতে রেহাই দেয় নাই। বাংলাদেশের কৃষি জীবনের সমস্ত ব্যর্থতা তাঁহার অন্তরে পুঞ্জীতূত হইল। এ দৃশ্য তাঁহার অপরিচিত থাকার কথা নয়। রৌদ্রে-বৃষ্টিতে সারা বৎসর খাটিয়া চাষী ক্ষেতে সোনার ধান ফলায়, আর নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবসায়ীর নৌকা আসিয়া তাহার সমস্ত ফসল উজাড় করিয়া লইয়া যায়। পড়িয়া থাকে কেবল শস্যহীন রিক্ত ক্ষেত্র, চাষীর মন হাহাকার করিয়া উঠে; এতদিন যাহা লইয়া সে ভুলিয়াছিল সবই যে থরে বিথরে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে, এখন কি লইয়া তাহার দিন কাটিবে? যে তরীতে তাহার সোনার ধান সাজানো হইয়াছে সেথায় তো তাহার ঠাঁই নাই। মহাজন শ্রমফলকে চায়, শ্রমিককে তাহার কি প্রয়োজন? সে কৃপা করিয়াও চাষীকে লইতে রাজি নয়, ঠাঁইয়ের এই অপব্যয় তাহার সইবে কেন? কাজেই সোনার তরী চাষীর যাহা কিছু ছিল লইয়া চলিয়া যায়। চাষী 'শূন্য নদীর তীরে' পড়িয়া থাকে, আর 'শ্রাবণ গগন ঘিরে' ঘন মেঘ তাহারই সমবেদনায় ঘুরিতে ফিরিতে থাকে।"
'সোনার তরী'র এই ব্যাখ্যার পক্ষে নীরেন্দ্রনাথ রায় তার 'কবিতায় বক্তব্য' নামক প্রবন্ধে অনেক জোরালো যুক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। এখানে সেসবের উল্লেখ করার স্থানাভাব। তার অনেক পরে, ১৯৬৯ সালের এপ্রিলে 'মানব মন' পত্রিকায়, পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ডা. ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় 'সোনার তরী'র যে ব্যাখ্যা দান করেন তার সঙ্গে অধ্যাপক নীরেন্দ্রনাথ রায়ের বক্তব্যের সাযুজ্যই শুধু নেই, সমাজতাত্তি্বক ও মনস্তাত্তি্বক বিশ্লেষণে তা অধিকতর যুক্তিগ্রাহ্য এবং বিজ্ঞানসম্মত রূপ প্রাপ্ত।
পেশাদার সাহিত্য সমালোচকদের নানা ধরনের অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে পাশ কাটিয়ে ডা. গঙ্গোপাধ্যায় যখন বলেন_ 'অতি পরিচিত সোনার তরী কবিতা চাষীর শ্রমবিচ্ছিন্নতা ও শ্রমোৎপন্ন ফসল থেকে বিচ্ছিন্নতার করুণ ছবি', তখন তার বক্তব্যের অভিনবত্বে হতচকিত হয়ে পড়ি বটে, কিন্তু এর সারবত্তা অস্বীকার করতে পারি না। 'সোনার তরী' কবিতাটির রচনাকাল ১২৯৮ সনের ফাল্গুন, অর্থাৎ ইংরেজি ১৮৯২ সাল। আমরা জানি : এরই এক মাস আগে 'সাধনা' পত্রিকায় বেরিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের 'ক্যাথলিক সোশ্যালিজম' এবং এর চার মাস পর 'সোশ্যালিজম' প্রবন্ধ; এরই বছরখানেক পর ভাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর কাছে লিখিত চিঠিতে 'দরিদ্র চাষী প্রজা'-দের দুঃখে কবি তার মর্মবেদনার কথা প্রকাশ করেছিলেন এবং এদের দুঃখের প্রতিকার হিসেবে 'সোশিয়ালিস্ট'-দের ধন-বিভাগ-নীতির প্রয়োগ সম্ভব কিনা ভাবছিলেন। যে কালে সমাজতন্ত্র সম্পর্কীয় চিন্তাভাবনা কবিমনকে এমনভাবে অধিকার করে রেখেছে, সে কালে রচিত 'সোনার তরী'র সর্বরিক্ত কৃষকের কোনোরূপ অধ্যাত্মরূপক বা প্রতীকী ব্যাখ্যার চেয়ে এর প্রত্যক্ষ অর্থ গ্রহণই তো অনেক বেশি যুক্তি বিচারসম্মত।
এভাবে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী রীতিতে বিশ্লেষণ করলেই রবীন্দ্রনাথের 'সোনার তরী' শুধু নয়, তার সব কাব্য তথা সাহিত্যকর্মের প্রকৃত মর্ম উদঘাটিত হতে পারে। অথচ তার বদলে আজো আমরা ভাববাদী বিচার-পদ্ধতির ঘোলা জলে হাবুডুবু খাচ্ছি।
'সোনার তরী'র 'মানস সুন্দরী' ও 'নিরুদ্দেশ যাত্রা' কবিতায় আমরা রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা ভাবনার বীজ প্রত্যক্ষ করেছি, কিন্তু এ বীজের লালনভূমিটিকে আমরা দেখেও দেখতে চাইনি। রবীন্দ্রনাথ মর্ত্যপ্রেমিক কবি, উচ্চ কল্পনা কুশলতার সঙ্গে তীক্ষ্ন বাস্তব দৃষ্টি তার কবিমানসের বৈশিষ্ট্য। এ বাস্তব দৃষ্টিই তাকে সংস্কারমুক্ত করেছে, কুসংস্কারের তথাকথিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে তিনি তীক্ষ্নধার ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ছুরি চালনা করেছেন। 'হিং টিং ছট' কবিতা তার প্রমাণ। তার মতো নির্মোহ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিসম্পন্ন কবি আলোকোজ্জ্বল পাশ্চাত্যভূমিতেও খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবু, মনে রাখা প্রয়োজন : রবীন্দ্রনাথ বাস্তববাদী হলেও বস্তুবাদী নন; তাই, অনেক সময়ই বাস্তবকে সঠিকভাবে অনুধাবন করেও বাস্তবাতিরিক্ত অতিলৌকিকতার ভাবনা দিয়ে তার কবিতাকে তিনি মুড়ে দেন। পৃথিবীর অন্যান্য ভাববাদী কবির মতো তিনিও সৌন্দর্যচেতনা ও কাব্য সৃষ্টির রহস্যের পুরো বাস্তব ব্যাখ্যা দিতে পারেন না, কবিতার সৃষ্টি প্রক্রিয়ার পেছনে এক রহস্যময়ী শক্তির অবস্থান মেনে না নিয়ে স্বস্তি পান না। সেই শক্তিকেই তিনি কল্পনায় মূর্তিমতি করে নাম দেন 'মানস সুন্দরী'। এ মানস সুন্দরীই 'নিরুদ্দেশ যাত্রা'য় কবির কাছে এক রহস্যময়ী নারী। এ নারীই 'সোনার তরী'র পরবর্তী কাব্য 'চিত্রা'য় 'জীবন দেবতা' ও 'অন্তর্যামী'। এ জীবন দেবতা তত্ত্ব নিয়ে ভাববাদী সমালোচকরা বড় বেশি মাতামাতি করেছেন, কাব্যপাঠককে কবিতা ও কবিমানসের সঠিক বিশ্লেষণদানে তারা ব্যর্থ হয়েছেন।
এখানেই বস্তুবাদী সমালোচনার ওপর বর্তে অপরিসীম দায়িত্ব। ভাববাদী কবিকে বস্তুবাদী বানানো নয়, কিংবা ভাববাদী বলেই কোনো কবির মহত্ত্ব অস্বীকার করে তাকে নস্যাৎ করে দেয়া নয়, বস্তুবাদী সাহিত্যবীক্ষা বরং ভাববাদী-বস্তুবাদী নির্বিশেষে সব কবি-সাহিত্যিকেরই সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে বৈজ্ঞানিক যথার্থতার সঙ্গে তুলে ধরে। রবীন্দ্রনাথের 'সোনার তরী' কাব্যের মর্মানুধাবনেও এ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সদাজাগ্রত রাখা একান্ত জরুরি। তাহলেই 'মানস সুন্দরী'সহ 'সোনার তরী'র সব কবিতায় কবির বাস্তব জীবন-ভাবনা ও সৌন্দর্য অনুধ্যানের স্বরূপ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে, এসব কবিতার রহস্যবাদী বা অধ্যাত্মবাদী খোলস আমাদের প্রতারিত করতে পারবেনা।
----যতীন সরকার( দৈণিক যায়যায়দিন)
 
Top