মহাকবি নিজামী

মহাকবি নিজামী

তাঁর নাম নিজামী। পুরা নাম আল ইলিয়অস ইউসুফ আবুবকর নিজামুদ্দীন নিজামী। হিজরী ৫৩৩ সনে তিনি ইরানের কুমে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুঈদ। নিজামী পন্ডিত বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ভাই বিখ্যাত কবি ছিলেন। নিজামী প্রথমে বিদ্যালয়ে শিক্ষা শেষ করেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই কবিতা রচনা করতেন। শিক্ষা অর্জনের পর তিনি কাব্য সাধনায় মন ঢেলে দেন। এসময় তার কবিতার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর সুখ্যাতি শুনে সে যুগের সম্রাটরা তাঁর প্রতি যথেষ্ট ভক্তি শ্রদ্ধা দেখাতেন। সকল সম্রাট তাদের দরবারে তাকে ডেকে নিয়ে বহু তাঁর কবিতা শুনতেন।
নিজামী সৎ ছিলেন। তিনি সততা পছন্দ করতেন। অসৎ লোকদের দেখতে পারতেন না। বাহরাম শাহ কবি নিজামীকে পছন্দ করতেন। কবি মখজনই আসরার কাব্য গ্রন্থ রচনা করে হিজরী ৫৫৯ সালে তাঁর নামে উৎসর্গ করেন। বাহারাম শাহ এতে খুশী হন। এবং কবিকে ৫ হাজার স্বর্ণমুদ্রা, অনেকগুলো উট এবং বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরিচ্ছদ উপহার দেন। মখজন রচনার সময় কবির বয়স ছিল ২৫ বছর।
নিজামীর জন্মভূমি গঞ্জ সেলজুক বাদশাহদের রাজত্বের সীমায় অবস্থিত ছিল। এ সময় এই বংশের সুলতান তুগরল বিন আরসান রাজত্ব করতেন। তিনি সাহসী, ন্যায় বিচারক ও জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নিজেও কবিতা রচনা করতেন এবং কবিদের সমাদর করতেন।
নিজামী সে সময় শিরীন ও খসরু রচনা শুরু করেছেন। এর সুনাম বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। তুগরলও জানতে পারলেন নিজামীর কাব্য রচনার কথা। তিনি কবির কাব্যের সাথে তাঁর নাম জড়িত করার অনুরোধ জানান।
নিজামী যখন ইই মসনভী রচনা করেছিলেন তখন তার এক বন্ধু তার সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি কবিকে শিরীন খসরু রচনা করতে দেখে অসন্তুষ্ট হলেন এবং বললেন, মিথ্যা কাহিনী রচনা করে কি লাভ? নিজামী বন্ধুর মন্তব্যের কোন জবাব না দিয়ে তার কাব্যখানা পড়তে শুরু করলেন। কাব্যের অপরূপ সৌন্দর্য্যে ও মাধুর্য্যে তার বন্ধু মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এরপর শিরীন খসরু কাব্যের ব্যাপারে তিনি আর কোন কথা বলতে পারলেন না।
কবির শিরীন খসরু কাব্য খো সমাপ্ত হয়েছে জানতে পেরে সম্রাট ফজল আরসান তাঁকে রাজদরবারে আসার আহবান জানালেন। পত্রবাহক রাজকীয় আমন্ত্রণ নিয়ে নিজামীর কাছে পৌঁছলেন। রাজার আদেশ তিনি মাথার উপর রাখলেন। সম্মানের সাথে চুমু খেয়ে তখনই ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে রওয়ানা হলেন। তখনকার দিনে সুপ্রশস্থ রাস্তাঘাট ছিল না। এখনকার মত যানবাহনও ছিল না। কবি দিনের পর দিন ঘোড়ায় চড়ে প্রান্তর ও বন অতিক্রম করতে থাকেন। একমাস পর তিনি সম্রাটের রাজধানীতে পৌঁছলেন। রাজদূত গিয়ে কবি নিজামীর আগমনের বার্তা ঘোষণা করলেন। সম্রাটের নির্দেশে তাঁর মন্ত্রী শামসুদ্দিন মাহমুদ কবিকে সঙ্গে করে রাজদরবারে নিয়ে আসেন। নিজামী যখন রাজদরবারে পৌঁছলেন সে সময় আনন্দ মজলিস বসেছে। প্রাসাদ সুন্দরভাবে সুসজ্জিত এবং গান বাজনা চলছিল। সম্রাট ফজল আরসালান কবি নিজামীর সম্মানার্থে গানবাজনা বন্ধ করে দিলেন। সিংহাসন থেকে উঠে নিজামীকে সসম্মানে উপযুক্ত স্থানে বসালেন। তাদের মধ্যে নানান বিষয়ে আলোচনা হল। কবি কবিতা পাঠ করতে চাইলেন। সে যুগে নিয়ম ছিল রাজদরবারে কবি নিজের কবিতা পাঠ করতেন না। বরং কবির সঙ্গে একজন লোক থাকতেন তিনি তা পাঠ করতেন। তাকে রাবী বলা হত। যতক্ষণ রাবী কবিতা পড়তেন ততক্ষণ কবিকে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। নিজামীও দাঁড়িযে থাকতে চাইলেন। কিন্তু ফজল আরসালান তাঁকে দাঁড়াতে নিষেধ করলেন।
রাবী যখন খসরু-শিরী শুরু করলেন তখন সম্রাট কবির কাঁধে হাত রেখে বিশেষ আগ্রহভরে তা’ শুনতে লাগলেন। রাজসভার সকলেই মহাখুশী হলেন। বাদশাহ নিজামীর দিকে লক্ষ্য করে বললেন, চিরকালের জন্য আপনি আমার নাম বিখ্যাত করে দিলেন। এর মুল্র দেয়া আমার জন্য কর্তব্য। তিন আরো বলেন, তাঁর ভাই কবিকে জায়গির হিসেবে যে দু’খানা গ্রাম দিয়েছেন তা’ তিনি পেয়েছেন কিনা? কবি হ্যাঁ সূচক জবাব দেন।
নিজামীর সুখ্যাতি ‍শুনে প্রত্যেক রাজা বাদশাহই তার নাম অমর করে রাখার জন্য কবিকে দিয়ে গ্রন্থ রচনা করিয়ে নিতে আগ্রহী হন। েএদের মধ্যে বাদশাহ মুনচেহর নিজ হাতে ১০/১৫ ছত্রের একটি পত্র নিজামীকে লিখে তাকে লায়লী মজনুর কাহিনী নিয়ে কাব্য রচনা করতে বললেন। তাঁর পত্র পেয়ে নিজামী চিন্তিত হয়ে পড়েন। এ সময় কবি ১৪ বছরের কিশোর পুত্র সেখানে উপস্থিত ছিল। কবি তাকে বললেন, এই লায়লী মজনুর কাহিনী কাব্য রচনার উপযুক্ত নয়। কেননা এটা একেবারেই দুঃখের কাহিনী। এটা কি করে উপভোগ্য রচনা করা যাবে- এ বিষয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন। পুত্র বলেন- ইতোপূর্বে আর কেউ এই কাহিনী কাব্য আকারে রচনা করেন নাই। কাজেই উহা রচনার জন্য তিনি পিতাকে অনুরোধ জানান। রাজকীয় আদেশ অনুযায়ী কবি ৪ মাসের মধ্যে লায়লী-মজনু রচনা শেষ করেন।
নিজামীর এই কাব্য রচনার পুরষ্কার হিসেবে সম্রাট কবি পুত্রকে রাজপুত্রের মত শিক্ষা-দীক্সা ও যাবতীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণের খরচ বহন করেন।
৫৯৩ হিরীর ১৪ রমজান কবি সুলতান গিয়াসুদ্দিনের নির্দেশে পয়বার নামক কাব্য রচনা করেন।
ফজল আরসালানের মৃত্যুর পর তাঁর ভাতিজা আবু বকর নাসিরুদ্দিন ৫৮৩ হিরজীতে সিংহাসনে বসেন। নেজামী বহুকাল বাদশাহদের ফরমায়েশ মোতাবেক কাব্য রচনা করেন। একবার তিনি নিজের ইচ্ছানুযায়ী সেকেন্দার নামা রচনা করেন। এতে নাসীরুদ্দিনের নামের উল্লেখ রয়েছে। এই কাব্য ৫৯৯ হিরীতে শেষ হয়। এই কাব্য রচনা করে তিনি রাজার কাছে উপহার পাঠান। সম্রাট তাকে মূল্যবান ঘোড়া ও কাপড়চোপ প্রদান কনে। নিজামীর পুত্রের সাথে এক সম্রাটের মেয়ের বিয়ে পর্যন্ত সম্পন্ন হয়। সেকান্দার নামা কাব্যে এ বিষয়ের উল্লেখ আছে। এটি রচনার সময় তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর।
এই গ্রন্থ শেষ হওয়ার সাথে সাথে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর বছর ছিল ৫৯৯ হিজরী।
তিনি সারা জীবন তাঁর নিজের ঘরেই কাটয়েছেন। বেশী লোকেরসাথে তিনি দেখা সাক্ষাৎকরতেন না। জীবনী কাররা তাঁর একটি বিশেষ গুণের প্রশংসা করে থাকেন। সেটা হচ্ছে তিনি রাজা বাদশাদের তোষামদ করা পছন্দ করতেন না। তারপরেও রাজা বাদশাহরাই তার সাথে বিশেষ আগ্রহের সাথে মিশতে চাইতেন এবং তাঁর কাছে আসতেন। তাঁকে প্রচুর পুরষ্কার দিয়ে রাজাবাদশাহরা সেজন্য গৌরববোধ করতেন।
নিজামী অসাধাণ কবি ছিলেন। ইরানে তাঁকে সাধারণত হেকিম নিজামী গঞ্জভী বলা হয়। নেজামী সারাজীবনতাঁর মাতৃভূমি গঞ্জে থাকতেন। তিনি খুব কমেই বাইরে ভ্রমনে যেতেন।তিনি ঘরকুনো ঘরনের লোক ছিলেন। কবি সারা জীবনে ্কবা মাত্র ঘর ছেড়ে বাদশাহ আরসালা সেলজুকীর আমন্ত্রণে তার দরবারে গিয়েছিলেণ।
নিজামী তিনটি বিয়ে করেন। তাঁর প্রথম স্ত্রীর নাম আফাক। বাদশাহ আরসালান যে উপহার সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন তার মধ্যে অপূরব সুন্দরী এক তরুনী ছিল। তার নাম আফাক।কবি তাকে বিয়ে করেন। স্ত্রীর প্রেমে মশগুল থাকাকালে নিজামী শিরীন খসরু কাব্য রচনা করেন। এই কাব্য রচনা শেষ হওয়ার পর আফাক ইন্তেকাল করেন। তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ত্রীর নাম ও পরিচয় জানা যায়নি।
কবির ছেলেদের মধ্যে মুহাম্মদ নামে তার এক পুত্রের কথা জানা যায়। শিরীন খসরু রচনাকালে তার বয়স ছিল ১৪ বছর। তাঁর এ পুত্রের হাত দিয়ে সম্রাটের কাছে ‘শিরীন খসরু’ কাব্যগ্রন্থ পাঠান। তাঁর ইকবাল নামায় এ বিষয়ের উল্লেখ দেখা যায়। নেজামী ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার কবরপাকা করে তার উপর গম্বুজ তৈয়ার করা হয়।
নিজামী ২০ হাজার ছত্র কবিতা রচনা করেন। তিনি মহৎ স্বভাবের কবি ছিলেন। তিনি বাদশাহ এবং আমির ওমরাদের সাথে থাকতে পছন্দ করতেন না। সমগ্র জীবন তিনি ঘরের কোনে কাটিয়েছেন। নতুন গঞ্জ শহর থেকে এক মাইল দূরে তাঁর কবর রয়েছে।
 
Top