আরজু আহমেদ নোমানী


এপ্রিলের বোকা।(ইতিহাস ভিত্তিক গল্প)।

আরজু আহমেদ নোমানী।

১৪/১১/২০১৬ইং।
আল্লাহু আকবার….আল্লাহু আকবার….লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ…..।মুয়াজ্জিনের মধুর কন্ঠে আজান হচ্ছে।প্রকৃতি অলসতা রেখে জেগে উঠতে শুরু করেছে।কুক্কুর কুক মোরগের ডাক শুনা যাচ্ছে…এমনি এক সুন্দর ভোরে নিয়াজের ঘুম ভেঙ্গে গেল।প্রতিদিনই খুব ভোরে তার ঘুম ভাঙ্গে। নিয়াজ দশ বছরের হলেও নামাজ আদায়ে তার কোন শৈথিল্যতা নেই।প্রতিদিনের মত আজো সে তার আব্বু,আম্মু আর দাদুকে ডাকতে লাগল। ফজরের আজান হলেই নিয়াজ বাড়ির কাউকেই ঘুমিয়ে থাকতে দেয়না,জ্বালাতন শুরু করে দেয়।ফলে সবাই নিয়াজের ভয়ে কাক ডাকা ভোরে উঠতে বাধ্য হয়।অগত্যা সকলে ফজরের নামাজও আদায় করে।
যথারীতি নিয়াজ দাদুর ঘরে গিয়ে দাদুকে ডেকে তুলল।নিয়াজের দাদু আব্দুর রহমান খুব পরহেযগার লোক।আব্দুর রহমানই নিয়াজকে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করেছে।দাদুই নিয়াজকে শিখিয়েছে কিভাবে ওযু করতে হয় এবং কিভাবে নামাজ আদায করতে হয়।এক কথায় দাদু নিয়াজের শিক্ষক।নিয়াজ দাদুর কাছ থেকে ইসলামী ইতিহাসের অনেক কিছুই শিখেছে।হযরত মুসা(আঃ) আর ফেরাউনের ইতিহাস ,ইব্রাহীম(আঃ) ও নমরুদের ইতিহাস,আদম(আঃ)-এর বেহেস্ত হারানোর কাহিনী,আমাদের প্রিয় নবী(সাঃ)-এর সংগ্রামী জীবনের ঘটনাবলী সহ অনেক ইসলামী গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসই নিয়াজ জানে।
দাদু এইমাত্র সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করলেন।নিয়াজও দাদুর সাথে সাথে বলল- ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ…. আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ….।’ নামাজ শেষ করে দাদু বলল,-‘নিয়াজ!যাও তোমার পড়া তৈরি কর। আল্লাহপাক মানুষকে তার ইবাদত শেষ করার পর দুনিয়ার কাজও করতে বলেছেন।শুধু আল্লাহ আল্লাহ তসবিহ জপবে আর দুনিয়ার কাজ পড়ে থাকবে সেটিও চলবেনা। মানুষ মনে করে পরিবার,সমাজ,রাষ্ট্র ইত্যাদির কাজগুলো দুনিয়াবি কিন্তু মানুষের এই ভাবনা ঠিক নয়। আল্লাহর হুকুম মোতাবেক পরিবার,সমাজ,রাষ্ট্র ইত্যাদি পরিচালনা করাও ইবাদত।
নিয়াজঃ দাদু!পারিবারিক ও সামাজিক বিধানটা কি?
দাদুঃ বলছি শুনো।তোমার আব্বু আম্মু কত আদর করে তাইনা?তোমার আম্মু কত কষ্ট সহ্য করে তোমাকে পেটে ধরেছে,তোমার আব্বু তোমার জন্য কত কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে তোমাকে সুন্দর সুন্দর জামা কিনে দেয়,পড়ার বই কিনে দেয়,খেলনা,সুস্বাদু খাবার আরো কত কিছু তোমাকে কিনে দেয়।তোমার প্রতি পিতামাতা হিসোবে এটা তাদের যেমন দায়িত্ব তোমারও সন্তান হিসাবে তাদের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে।মা-বাবা আল্লাহপাকের অমূল্য সম্পদ।তাদেরকে কিছুতেই কষ্ট দেয়া যাবেনা।আল্লাহপাক সন্তানদেরকে পিতা মাতাকে সম্মান করতে হুকুম দিয়েছেন।আর পিতা মাতার জন্য দোয়াও শিখিয়ে দিয়েছেন।প্রত্যেক নামাজের পর পড়বে।
নিয়াজঃ দোয়াটা কি দাদু?
দাদুঃ দোয়াটা হল,‘রাব্বির হামহুমা কামা রব্বায়ানিসসাগিরা।’ আর সামাজিক ভাবে তোমার প্রতিবেশীর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া যাবেনা।তাছাড়া মিথ্যা বলা যাবেনা,চুরি করা যাবেনা,কাউকে কথা দিলে কথা রাখতে হবে,কাউকে ঠকানো যাবেনা…এ ধরনের সমাজের অনেক কাজই আছে যা আল্লাহর হুকুম মোতাবেক করতে হয়।এগুলো পালন করলে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে।আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)ও সমাজে দায়িত্ব পালন করেছেন।
নিয়াজঃ কিন্তু দাদু সামির সেদিন আমাকে মিথ্যা কথা বলে ঠকিয়েছিল,এতে তার গুণাহ হবেনা?
দাদুঃ মিথ্যা বলাতো জঘণ্য পাপ আর ধোঁকা দেয়া আরো জঘণ্য!
নিয়াজঃ সামির বলেছে তার মামা না-কি অনেক সুন্দর সুন্দর খেলনা নিয়ে এসেছে তাই সে আমাকে নিতে এসেছে। আমানে জন্যও নাকি এনেছে।মনে সে-কি আনন্দ!অথচ তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখি তার মামা আসেইনি।দাদু জানো সেদিন আমার খুব কান্না পেয়েছিল।আর সামির হাসতেছিল আর বোকা বোকা বলে আনন্দে হাততালি দিতে ছিল।আমার খুব কষ্ট লেগেছে তাই তার সাথে আঁড়ি নিয়ে চলে এসেছি আর কোনদিন তার সাথে কথা বলবোনা।
দাদুঃ উঁহু!তুমি ঠিক করনি।তুমি যেমন মুসলমান সামিরও মুসলমান।এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই।মুসলমান ভাইয়ের সাথে তিনদিনের বেশি কথা বন্ধ রাখতে আমাদের প্রিয় নবী(সাঃ) নিষেধ করেছেন।তবে সামির তোমাকে ধোঁকা দিয়ে জঘণ্য অপরাধ করেছে।মানুষ মাত্রই ভুল করে।হয়তো সামির না বুঝে করেছে তাকে শুধরাতে হবে।যাও এখন পড়তে যাও।বিকেলে সামিরকে আমার কাছে নিয়ে এসো।
[দাদু নিয়াজকে পড়ার ঘরের দিকে আঙ্গুলে ইশারা করে উঠে গেল।নিয়াজ ধীর পদক্ষেপে পড়ার ঘরে প্রবেশ করলো]।
বিকেল বেলা। দাদু বারান্দায় বসে বই পড়ছেন।এমনি সময় সামিরের ডাকে দাদুর মনোযোগ ভাঙল।
সামিরঃ আসসালামু আলাইকুম দাদু!
দাদুঃ ওয়ালাইকুমুস সালাম….
সামিরঃ দাদু আপনি আমাকে ডেকেছেন?
দাদুঃ হ্যাঁ,দুজনেই বসো।[নিয়াজ ও সামির দুজনেই দাদুর কাছে রাখা চেয়ারে বসলো]।
নিয়াজঃ জানো দাদু,আমি সামিরকে এত করে তোমার কথা বললাম তবু সে আসতে চায়নি।
সামির মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললঃ দাদু আমি ইয়ে….মানে ইয়ে…মনে করেছিলাম হয়তো নিয়াজ আমাকে ঠকাবে।[সামিরের চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে]।
দাদুঃ দেখো সামির! অপরাধী অপরাধ করে কোনদিনই স্বস্থি পায়না।যে মানুষকে ধোঁকা দেয় সে নিজেও ধোঁকায় পড়ে।যাক,তুমি সেদিন নাকি নিয়াজকে তোমার মামার কথা বলে ঠকিয়েছো?তুমি জানো মিথ্যা বলে ঠকানোতে তোমার জঘণ্য অপরাধ হয়েছে?আমাদের প্রিয় রাসূল(সাঃ)বলেছেন,যখন কেউ মিথ্যা বলে তখন তার মুখের দূর্গন্ধের কারণে ফেরেশতারা তার কাছ থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়।এতেই বুঝা যায় মিথ্যা কত জঘণ্য!তাছাড়া তুমি রিয়োজের মনে দুঃখও দিয়েছো তাইনা?
সামিরঃ কিন্তু দাদু,সেদিনতো ছিল পহেলা এপ্রিল।আমি ‘এপ্রিল ফুল’ পালন করেছি।এতে আমার অপরাধ কেন হবে?
দাদুঃ ও তা-ই নাকি? কিন্তু ‘এপ্রিল ফুল’ কি তা তোমরা জানো?
সামিরঃ কেন জানবোনা সবাইতো এদিন কতজনকে বোকা বানিয়ে কত মজা করে!
দাদুঃ না,এটা হলনা।তুমি কি ‘এপ্রিল ফুল’-এর ইতিহাস জানো?এর মানে বুঝ?
সামিরঃ না দাদু।
দাদুঃ ‘এপ্রিল ফুল’ একটি ইংরেজী শব্দ।এপ্রিলতো জানোই এটি একটি ইংরেজী মাসের নাম আর ফুল ইংরেজীতে `Fool’ মানে বোকা।অর্থাৎ, ‘এপ্রিল ফুল’ মানে ‘এপ্রিলের বোকা’।
নিয়াজঃ ‘এপ্রিলের বোকা’ কারা দাদু!
সামিরঃ [মুচকি হাসি দিয়ে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে] আর কে তুমিইতো এপ্রিলের বোকা!সেদিন তোমাকে কি বোকাইনা বানালাম।
দাদুঃ চুপ কর সামির পহেলা এপ্রিল মুসলমানদের আনন্দ উল্লাসের দিন নয়।নিয়াজ যেমন ‘এপ্রিলের বোকা’ তুমিও ‘এপ্রিলের বোকা’।সব মুসলমানরাই ‘এপ্রিলের বোকা’।
সামিরঃ কিন্তু আমার বন্ধুরাতো এপ্রিল ফুল পারন করে।তারা কত মজা করে।
দাদুঃ হ্যাঁ করে। ওরাই করে যারা এপ্রিলের সত্যিকারের বোকা।যারা নিজেদের ইতিহাস জানেনা।তারা কেউ জানেনা….[দাদুর চেহারা লাল হয়ে উঠে]।
নিয়াজঃ দাদু পহেলা এপ্রিল কি ঘটেছিল আমাদের ইতিহাসে?
দাদুঃ পহেলা এপ্রিল মুসলমানদের ইতিহাসে একটি জঘণ্যতম অধ্যায়।বলছি মন দিয়ে শুন।স্পেন একটি দেশের নাম।মুসলমানদের সেনাপতি মুসা স্পেনকে জয় করে ইসলামের পতাকাতলে নিয়ে আসার পর গোটা ইউরোপে ইসলামের সাজ সাজ রব পড়ে যায়।গোটা ইউরোপ ইসলামের আলোর ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে উঠে।
[নিয়াজ ও সামির খুব মন দিয়ে দাদুর কথা শুনছে।দাদু একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন]।
কিন্তু দুঃখের বিষয় কি জানো মুসলমানদের অলসতা,ভোগ বিলাসিতা এত চরমে পোঁছেছে যে তারা আল্লাহ ও রাসূলকে ভুলে গিয়ে হারিয়ে ফেলে ইসলামী চেতনা।যেমনি আজ আমরা এপ্রিলের সত্য ইতিহাস ভুলে গেছি।
নিয়াজঃ তারপর কি হল দাদু?
দাদুঃ এই সুযোগে খৃষ্টান দলপতিরা চারিদিক থেকে মুসলমানদেরকে উৎখাতের লক্ষ্যে মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে লাগল।মনে রাখবে ইহুদী আর খৃষ্টানেরা কোনদিনই মুসলমানদের ভাল নজরে দেখেনি দেখবেও না।
সামিরঃ ওরা কিভাবে আমাদেরকে বোকা বানালো?
দাদুঃ এরপর খৃষ্টানেরা মুসলিম অধ্যুষিত ষ্পেনে শয়তানি প্রতারণা,আজাজিলী অত্যাচার আর ফিরাউনি নির্যাতন চালিয়ে একের পর এক মুসলিম এলাকাগুলো দখল করতে লাগল।
নিয়াজঃ মুসলমানদের হাতে কি অস্ত্র ছিলনা?তারওতো শত্রুদের প্রতিহত করতে পারতো?
দাদুঃ হ্যাঁ ছিল।মুসলিম জাতি আগের থেকেই দুঃসাহসি জাতি।তারাও লড়াইয়ে নেমেছিল।খৃষ্টানদল দেখল এভাবে তারা মুসলমানদের সঙ্গে পারবেনা তাই তারা কৌশল অবলম্বন করলো,ধোঁকার আশ্রয় নিল।
সামিরঃ কিভাবে দাদু?
দাদুঃ বলছি শুন।খৃষ্টান দলপতি ফার্ডিন্যান্ড তার সৈন্যদল সহ রাজধানী গ্রানাডায় উপস্থিত হয়ে ঘোষণা করলো যে,যদি মুসলমানেরা অস্ত্র ত্যাগ করে বিনা বাধায় শহরে প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় সকল মুসলমান মসজিদ সমূহে আশ্রয় গ্রহণ করে তাহলে তাদেরকে বিনা রক্তপাতে মুক্তি দেয়া হবে।মুসলমান জাতি শান্তি প্রিয় জাতি।তাই বিনা রক্তপাতের আশ্বাসে তারা আবাল,বৃদ্ধ,বণিতা সকলেই যুদ্ধ বন্ধ করে নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করলো। তখনই বিশ্বাসঘাতক ফার্ডিন্যান্ডের হুকুমে বর্বর খৃষ্টান সৈন্যরা মসজিদ সমূহে আগুণ ধরিয়ে দিল।প্রাণ বাঁচাতে যারাই মসজিদ থেকে বেড়িয়েছে তাদেরকে নিমর্মভাবে হত্যা করেছে ঐ পাষান্ড খৃষ্টানদল।নিরাপরাধ মুসলমানদের রক্তে লাল হয়ে গেল গ্রানাডার রাজপথ।এই প্রতারণার ইতিহাসটি ঘটেছিল ১৪৯২ইং সালের ১লা এপ্রিল।তাই ফার্ডিন্যান্ড তখন হেসে বলেছিল,হায় মুসলমান জাতি! তোমরাতো ‘April fool’(এপ্রিলের বোকা)।আর এই ধোঁকাবাজির দিনটিকে স্মরণ রাখার জন্য খৃষ্টান জগত এপ্রিল মাসের প্রথম তারিখে ‘এপ্রিল ফুল’ পালন করে থাকে।
[এই নিষ্ঠুর ধোঁকাবাজির ইতিহাস শুনে কখন যে নিয়াজ ও সামিরের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তা তারা জানেনা।দাদুর কথা শেষ হতেই তারা লক্ষ্য করল দাদুরও চোখে পানি টলমল করছে]।
সামিরঃ[চোখ মুছে] দাদু,আমার ভুল হয়ে গেছে।আমি সত্যিই গুণাহগার!
দাদুঃ অনুশোচনাতেই পাপ খন্ডায়।তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছো তাই আশা করা যায় আল্লাহপাক তোমাকে ক্ষমা করে দিবেন।তাছাড়া তুমিতো না জেনে করেছো।জেনে রাখবে কোন কিছু না জেনে কিছু করবেনা।
সামিরঃ[নিয়াজের দিকে তাকিয়ে] আমাকে ক্ষমা করে দাও বন্ধু!আর কোনদিন মিথ্যা বলবোনা,ধোঁকা দিবনা।
নিয়াজঃ তুমি না বুঝে ভুল করেছো,তাই এটি কোন ভুলই নয়।আল্লাহ তোমাকে আমাকে সবাইকে ক্ষমা করুন।
[নিয়াজ,সামির,দাদু সবাই সমস্বরে বলল-‘আমিন….আমিন…]।
 
Top