গল্পকার নাসীমুল বারী’র চমৎকার একটি শিক্ষনীয় ছোট গল্প :: অবশেষে দেখা হলো

অবশেষে দেখা হলো

।। নাসীমুল বারী ।।


মনটা ভালো নেই সুমির।
বাইরে বৃষ্টি। আলতো বাতাস। শীতল আমেজে আবছা আঁধারিতে দারুণ একটা দৃশ্য। এমন আবেশে কিছু একটা লেখতে মন টানছে, পারছে না। মনে ভাব আছে, কিন্তু লেখার ভাষাটা নেই সুমির। অথচ ফেসবুকের বন্ধুরা কী চমৎকার লিখে যাচ্ছে!
তারপরও লেখার জন্য ভাবছে। বসে বসে ভাবছে। কবিতা, গল্প, ছড়া লেখতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু- - -!
হঠাৎ ফোন আসে।
ওমা একি, বন্ধু সন্ধ্যালতার ফোন! এমন অসময়ে তো ফোন করার কথা না। ফোনটা ধরতেই সন্ধ্যালতা বলে- এই ফেসবুক দেখছিস?
-না, অনেকক্ষণ যাই নি ওধারে। কী হয়েছে?
-তুই তোর স্কুলের বৃষ্টিভেজা ছবিটা পাঠিয়েছিস তো?
-হু।
-দেখ ‘দন্ত ন আবদুল্লাহ’ নামে এক ভদ্রলোক কী চমৎকার কমেন্ট করেছে। উহ! দারুণ!
ঔৎসুক্য হয়ে সুমি বলে, কী লিখেছেরে?
-তুই-ই দেখ। ভদ্রলোকের নামটাও চমৎকার।
-ওসব ছদ্মনাম।
-আরে না, না, আমি টাইমলাইনে গিয়ে দেখেছি, তাতে নিকনেইম তো মনে হলো না। সব পরিচিতি আছে। ছবি আছে।
-আচ্ছা! ছাড়তো দেখতে হবে এক্ষুণি।
প্রিয় বন্ধু সন্ধ্যালতা। ফেসবুকেও, বাস্তব জীবনেও। ওর ফোনটা ছেড়েই তাড়াতাড়ি মোবাইলের ফেসবুক খোলে। স্ট্যাটাসে যায়। চমকে যায় কমেন্টটা পড়ে। ‘দন্ত ন আবদুল্লাহ’ নামের একজন ছবিটা দেখে বড় একটা কমেন্টস দিয়েছে। কমেন্টসে বৃষ্টিকে কবিতা বানিয়ে ফেলেছে। শেষ অংশটা এমন- ‘বৃষ্টি দেখাতেও কবিতা আছে। বৃষ্টি ঝড়ে পড়াতেও কবিতা আছে। বৃষ্টির নূপুরেও কবিতা, ছন্দেও কবিতা। টুপটাপ ঝরে পড়াতেও কবিতার ছন্দ দোলে উঠে।’ এত সুন্দর কথামালা! তাড়াতাড়ি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় সুমি।
সুমির ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড দন্ত ন আবদুল্লাহ। নামটাও একদম ভিন্ন। বর্ণমালা দিয়ে নাম। তার লেখাগুলো পড়ে। ভালো লাগে লেখা। ওই তো একদিন ‘মূল্যবোধ’এর উপর একটা স্ট্যাটাস দেয়। অল্প কথায় সহজ ও চমৎকার বিশ্লেষণ। সুমি কমেন্ট করার সাথে সাথে উত্তর আসে, ‘রাত গভীরে না ঘুমানো চোখে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।’
‘বাহ্! এত সুন্দর কথা! ভাবের কী চমৎকার বিন্যাস! আমি কেন লিখতে পারছি না?’ মনে মনে ভাবে সুমি। ইচ্ছে জাগে সুমিরও দারুণ কিছু লিখতে। ‘আচ্ছা ওনার সাথে কথা বলতে পারলে মনে হয় লেখালেখির কিছু টিপস পেতে পারি। কী ভাবে কথা বলব?’ ফেসবুক চালানো বন্ধ রেখে ভাবছে সুমি। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি আসে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং করি? কিন্তু- - -! উনি সে সময় দেবেন? সাহস হলো না আর।
কদিন পরে সুমির একটা অনুগল্পে দন্ত ন আবদুল্লাহ মতামত দেয়- এটা তো গল্প নয় ধারাবর্ণনায় আলেখ্য মাত্র। গল্পে থাকে ভাব আর কল্পনার শৈলীতে ঘটনার বিন্যাস। থাকে রূপকল্পে উপমাচিত্রও।
সাথে সাথে ইনবক্সে সুমি লিখে- আমার মনে ভাব আছে ভাষা নেই। লিখব কীভাবে বলুন না?
-সহজ। ভাব যখন আছে, লেখাটা সহজ।
-মোটেই না।
-ইচ্ছে থাকলে সহজ। ভাবের সাথে অনুভব-চেতনার শৈল্পিক প্রকাশই তো সাহিত্য।
-ভাবের প্রকাশটা কথা নয় কি?
সুমি প্রশ্ন করে। সুমির প্রশ্নে জবাবে দন্ত ন বলেন, কথা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আবার এ কথা থেকেই সাহিত্য সৃষ্টি হয়।
-বুঝি, কিন্তু পারি না।
-পারবেন। আত্মবিশ্বাসে চর্চা করুন।
-আরও কিছু বলুন দেখি।
-মানুষের চেতনায় আছে অনুভূতি। অনুভূতি প্রকাশে যদি রং থাকে, সুর থাকে, ছন্দ থাকে তখনই কল্পনায় ছবি তৈরি হয়। এমন চিত্রকল্পানুভূতি তখন কথা থাকে না; হয়ে ওঠে সাহিত্য। কথার সাথে সাহিত্যের এখানেই তফাৎ।
-তার মানে এভাবে কবিতাই লিখা হয়। তাই তো? তাহলে কবিতাটা কী।
-ভাবের জাগরণে মনের অনুভূতি কাব্যের অনুরাগেই কবিতা হয়ে প্রকাশ পায়। হৃদয়াবেগের চিত্রকল্পিত সাহিত্য প্রকাশই কবিতা। এমনি কতভাবেই তো কবিতার অস্তিত্ব প্রকাশ করা যায়।
-থাক আর লাগবে না। গল্প সম্পর্কে বলুন তো।
-কল্পানুভবের গল্পকথার সারাংশই ছোটগল্প।
-বাহ্! ছোট্ট কথায় চমৎকার বললেন তো গল্প সম্পর্কে। আমি লিখব, কিন্তু গল্প না কবিতা, আপনি বলুন।
-হা, হা, হা।
-হাসলেন যে?
-কী করব! লিখবেন আপনি, বলে দেব আমি? আচ্ছা শুনুন, গল্প বলেন আর কবিতা যা-ই লিখেন, আগে শব্দের ব্যবহার জানতে হবে।
-যেখানে যে শব্দ, সেখানে তা ব্যবহার। এতে ব্যবহার জানা বিষয়টা কী?
-আছে। শব্দের ব্যবহার দুইভাবে হয়; তত্ত্বগত, অনুভবগত। অনুভবটাও দুইভাবে- রূপক, উপমা।
সন্ধ্যালতার ফোন আসে। চ্যাটিংটা বন্ধ হয়ে যায়। একটু বিরক্ত হয়ে বলে- ধ্যাৎ! তবু ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে- সুমি দন্ত ন দারুণ এক স্ট্যাটাস দিয়েছে।
-স্ট্যাটাস! কখন দিলো? আমিই তো ওনার সাথে এতক্ষণ চ্যাটিং করছিলাম।
-কী ওনার সাথে চ্যাটিং! জমিয়ে ফেলেসিছ ভদ্রলোকের সাথে!
-রাখ্ ও কথা। আগে বল কখন স্ট্যাটাস দিলো।
-অত বুঝি না। তুই দেখ ওনার তিন শ্বশুরবাড়ির স্ট্যাটাসটা, আমি ফোন ছেড়ে দিচ্ছি।
তাড়াতাড়ি পেজ ওপেন করে সুমি।
স্ট্যাটাসের সময় দেখে, পুরোনো। ঈদের সময়ের। কেউ লাইক দেওয়ায় সামনে চলে এসেছে। স্ট্যাটাসটা এমন-
“তিন শ্বশুরবাড়ির একটিতেও বেড়ানো হলো না এ ঈদে
ঈদের ছুটিতে আমি তিন শ্বশুরবাড়ির কোনো না কোনো একটিতে যাই-ই। অদল-বদল করে এবার এ শ্বশুরবাড়ি তো পরেরবার ও শ্বশুরবাড়ি। এবার ঈদের দিন থেকে দাঁতে প্রচন্ড ব্যথা। ঈদের দিন কোনো রকমে কাটানোর পর দাঁত মেরামতের জন্য বন্ধু ডা. লুলুর শরণাপন্ন হতে চাইলাম- কিন্তু ঈদের ভ্যাকেশান, বন্ধুকে পাওয়া গেলেও চেম্বার তো আর খোলা থাকবে না। দাঁতের ব্যাপার-স্যাপার, শুধু ডাক্তারকে পাওয়া গেলে চলবে না চেম্বারটাও লাগবে। আর যেন-তেন মেরামতও নয়, শ্বশুরবাড়ি খাবার খাওয়ার মতো মোরমত। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম কোনো শ্বশুরবাড়িই যাব না। জাউ খেতে হচ্ছে। আজ সকালে উঠে দেখি বৌ একমাত্র ছেলেটাকে নিয়ে পরিপাটি। আমাকে বলে- জাউ রেঁধে গেলাম, রাত পর্যন্ত চলবে।
-কোথায় যাচ্ছ তুমি?
শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম।
না, বৌ আমার মেজাজ করে নি। সেও ততোধিক শান্তকণ্ঠে বলে- তোমার শ্বশুরবাড়ি।
-কেন?
এবার একটু ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে- আমার তো দাঁত ব্যথা নেই।
-------------
ও আচ্ছা আমার তিন শ্বশুরবাড়ির পরিচয়টা বলছি- একটি আমার শ্বশুরবাড়ি, ২য়টি আমার বাবার শ্বশুরবাড়ি আর শেষটি আমার মায়ের শ্বশুরবাড়ি।”
-হা, হা, হা! দারুণ মজার স্ট্যাটাস তো!
মনে মনে বলে সুমি। সাথে সাথে ফোন দেয় সন্ধ্যালতাকে। ও ধরেই বলে- কী রে দেখেছিস?
-মানে! এটা না দেখে পারি। মজার কথা লেখছেরে। এখনই চ্যাটিং-এ যাব।
-গ্রুপ চ্যাট কর, আমিও থাকব।
চ্যাটিং শুরুতইে সুমি দন্ত নকে বলে- আচ্ছা মানুষ তো আপনি।
-কেন? কী হয়েছে।
-আপনার তিনটে শ্বশুরবাড়ি, আগে বলবেন না?
-আমার তো আরেকটা বানানোর ইচ্ছে নেই যে আপনাকে জানাব।
-ওয়াও! দারুণ বলছেন এবারও।
সন্ধ্যালতার এ রিপ্লাইতে দন্ত ন বলে- কী ব্যাপার গ্রুপ বেধে আমাকে আত্রমণ করছেন নাকি?
-হতে পারে।
-কোমরে শাড়ি না ওড়না কোনটা পেঁছিয়েছেন?
-হা, হা, হা। হেসে দেয় সুমি, সন্ধ্যালতাও। তারপর সন্ধ্যালতা বলে, মেয়েদের ঝগড়া বুঝি খুব দেখেন? সাথে সাথে সুমি বলে, রাখ সন্ধ্যা ওসব কথা। এই আপনাকে একটা কথা বলছি শুনুন।
-আপনাদের ঝগড়াটা ভালই লাগছিল, বলেন।
-এই যে তিন শ্বশুরবাড়ির কথা লিখলেন, এটাও তো শব্দের ব্যবহার তাই না?
-না। এখানে কোনো শব্দ কি ভিন্ন কোনো অর্থ প্রকাশ করছে। মোটেই না।
-তবে?
-এখানে ভাবটা ভিন্ন ভাবে বলা হয়েছে। আমার বাড়ি মানেই তো আমার মায়ের শ্বশুরবাড়ি, নানার বাড়িই তো বাবার শ্বশুরবাড়ি। এই আর কি। আমাদের জানা জিনিস। আমি এ ভাবটাকেই ভিন্ন ভাবে প্রকাশ করেছি। এভাবে ভাবকেও আপনি ভিন্নভাবে প্রকাশ করতে পারে। শব্দ আর ভাবের খেলাই তো সাহিত্য।
-তাহলে শব্দ আর ভাবকে জানতে হবে, তাইতো?
সন্ধ্যলতা বলে।
-ঠিক তাই। শব্দের নানা রঙের ব্যবহার কবিতায় বেশি হয়। শব্দই কবিতার আলপনা। গল্পে ভাবের রং-রূপই বেশি। কথার সাথে কল্পনা আর অনুভূতির সৃজনেই সাহিত্যের ভাব ধারণ করে। সেই ভাবের পিচঢালা পথই গল্প।
-আর?
-গল্পের চরিত্রের সাথে নিজেকে একদম মিশিয়ে ফেলতে হবে। মনে করবেন গল্পের চরিত্রই আপনি। তবেই গল্পে স্বতঃস্ফূর্ততা পাওয়া যাবে।
অনেকদিন দন্ত ন আবদুল্লাহর কোনো উপস্থিতি নেই ফেসবুকে। ম্যাসেঞ্জারে নক করলেও সাড়া দেয় না। কাল থেকে জেএসসি পরীক্ষা। স্কুলেই সেন্টার পড়েছে। সুমিকে খুব ব্যস্ত থাকতে হবে। কী করা যায় ভাবছে?
আজ জেএসসি পরীক্ষা শুরু। একটু আগেই স্কুলে চলে আসতে হয়েছে সুমিকে। গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়েই চমকে যায়। আরে মাথায় চুল নেই চেনা চেনা এক ভদ্রলোক এক পরীক্ষার্থীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আলতো দূরত্বে গিয়ে ভাল করে পরখ করছে সুমি, কে এ ভদ্রলোক? পরীক্ষার্থী মনে হয় তাঁরই ছেলে। তাকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিতে একটু হাসলেন। অমনি ‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার দিতে ইচ্ছে হলো সুমির। এ যে ফেসবুকের সেই লোক- দন্ত ন আবদুল্লাহ্। সেই ছবির হাসিটা, চেহারাটা- একদম সাধারণ।
ভদ্রলোক গেট ছেড়ে দূরে সরে এলেন। সুমিকেও স্কুলে ঢুকে যেতে হবে এক্ষুণি। পরীক্ষার ডিউটি। দ্রুত তাঁর কাছে গিয়ে বলে, আপনি কি- - -!
আর কোনো কথা বের হয় না। তিনি শান্ত কন্ঠে বলেন- আমি দন্ত ন আবদুল্লাহ্। আপনি?
-শ্রদ্ধা গুরু। আমার ডিউটি শুরু হয়ে যাচ্ছে, পরে কথা হবে ফেসবুকে। আমি সুমি।
স্কুলের বেল বেজে উঠল খুব জোরে। দ্রুত ঢুকে পড়ে স্কুলে সুমি।
#
২৩ নভেম্বর, ২০১৬
 
Top