শরতের জোৎস্নালোকিত রাত ক্রমশঃ বেড়েই চলছে,উঠোনময় চাঁদের নির্মল আলো ঝলমল করছে,জানালার শিক ধরে অধীর আগ্রহে স্বামী শিমুলের আগমনের অপেক্ষায় অর্পিতা। অর্পিতা ওর আসল নাম নয়, প্রকৃত নাম আশামনি। মা আদর করে ডাকেন আশালতা,খালা ডাকেন সোহাগী বলে,স্কুলের খাতায় ছিল আঞ্জুমান আরা।
মা-বাবার একমাত্র আদরের কন্যাদের এমন এক ডজন নামও বিচিত্র কিছু নয়।
বাবা মৃত্যু শয্যায় কচি লাউ-ডগার মতো কোমল কিশোরী হাতটা শক্ত সামর্থ শিমুলের কর্মঠ হাতে সঁপে দিয়ে বলেছিলেন "দেখে রেখো অবুঝ মেয়টাকে"
সেই থেকে অর্পিতা। শিমুল এ নামেই ডাকে,অর্পিতাও স্বচ্ছন্দবোধ করে তাই এ নামেই এখন বেশ পরিচিত।
অর্পিতার সাথে আমার পরিচয় মাত্র দিন দশেক আগে ওর ছোট মেয়ের স্কুল গেটে, আমি এপথেই যাচ্ছিলাম অফিসের কাজে, পরিচিত কাউকে মনে করে ও ডাকছিল- 'ভাইজান শুনেন' পেছনে ফিরতেই জিহ্বায় কামর দিয়ে লজ্বাবনত মস্তকে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলতে থাকলো "সরি ভাইয়্যা,আমি ভেবেছিলাম.....।
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম মানুষের মতো মানুষ অনেক আছে বোন,মাঝে মাঝে আমারও এমন হয়।
এর পর আরও দু-একবার দেখা ও কথা হলেও শেষ দেখা করতে সেদিন ওদের বাসায় গেলাম। স্বামী-স্ত্রী আর তিন মেয়ে মিলে পাঁচ সদস্যের ছিমছাম পরিপাটি সংসার,বড় মেয়ে চম্পা,মেঝো মেয়ে রানী আর ছোট মেয়ে ইতি,পরপর তিনটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে হয়ত ক্লান্ত,শংকিত মনে আর কোন কন্যা সন্তানের মুখ দেখতে চায় না বলেই হয়তো ছোট মেয়েটার নাম ইতি রাখা হয়েছে। এত মায়া-মমতা আর ভালবাসায় মোড়ানো হৃদয়েও যে হতাশা আর অপ্রাপ্তি গুলো মানুষকে গোপনে কাঁদায় সেটা কারো কাছাকাছি না গেলে বোধ হয় বুঝাই যায় না।
একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে শিমুল,ফেরে রাত এগারোটায়, কোনদিন বারোটা। সরকারী চাকুরীর বয়স পেরিয়েছে সে কবেই। তাতে কি? কোম্পানিতেও বড় পদে মোটা বেতনে চাকুরী করার সুবিধার কথা শুনে চাকুরী জীবনে তিল-তিল করে জমানো সমুদয় টাকা বসের হাতে উৎকুচ দিয়েও যখন নিশ্চয়তা মিলে না তখন অর্পিতার সাধের গয়না বিকিয়ে আরো পঞ্চাশ হাজার টাকা জোগাড় করে আনন্দ-বেদনার দোলাচলে
বাড়ি ফিরে শিমুল,দরজায় মৃদু শব্দ করে,অর্পিতা দরজা খুলে দেয়। সে জেগেই ছিল এতক্ষন।
-কি ব্যাপার? তোমাকে এত বিষন্ন লাগছে কেন?
- ও কিছু না, তোমার সাধের গয়নাগুলো বিক্রি করে দিতে হয়েছেতো,তাই হয়তো...
-ওসব ভাবছো কেন? স্বামীর প্রয়োজনে যদি স্ত্রীর গয়না কাজেই না লাগে তবে সে গয়নার কোন মুল্যই থাকে না।
তাছাড়া চাকরিটা পেলে তুমি অনেক শাড়ী-গয়নাইতো দিতে পারবে আমায়।
- তা ঠিক বলেছো,কোন সামর্থবান স্বামীই চায় না তার স্ত্রীর গয়নাহীন অসুন্দর চেহারাটা দেখতে ।
সে রাতে ঘুমজড়ানো চোখে দুজনেই স্বপ্নমগ্ন রাত অতিবাহিত করে, বড় মাপের চাকুরী, অভাবহীন স্বচ্চন্দ জীবনে লালরঙা মোটর বাইকে চড়ে যমুনা সেতুর উপড় দিয়ে ঘুরে বেড়াবে দুজন দুজনার আরো আপন হয়ে,ভালবাসার গভীর মাখামাখি নিয়ে, রাজশাহী শহরের সেরা বিপণিবিতান থেকে সবচেয়ে দামী শাড়ী,চব্বিশ ক্যারেট খাঁটি সোনার গয়না পড়ে অভিজাত রমনীর মতো ছোট মেয়ের স্কুল গেটে অপেক্ষা করবে কখন ছুটির ঘন্টা বাজবে।
মা-বাবার একমাত্র আদরের কন্যাদের এমন এক ডজন নামও বিচিত্র কিছু নয়।
বাবা মৃত্যু শয্যায় কচি লাউ-ডগার মতো কোমল কিশোরী হাতটা শক্ত সামর্থ শিমুলের কর্মঠ হাতে সঁপে দিয়ে বলেছিলেন "দেখে রেখো অবুঝ মেয়টাকে"
সেই থেকে অর্পিতা। শিমুল এ নামেই ডাকে,অর্পিতাও স্বচ্ছন্দবোধ করে তাই এ নামেই এখন বেশ পরিচিত।
অর্পিতার সাথে আমার পরিচয় মাত্র দিন দশেক আগে ওর ছোট মেয়ের স্কুল গেটে, আমি এপথেই যাচ্ছিলাম অফিসের কাজে, পরিচিত কাউকে মনে করে ও ডাকছিল- 'ভাইজান শুনেন' পেছনে ফিরতেই জিহ্বায় কামর দিয়ে লজ্বাবনত মস্তকে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলতে থাকলো "সরি ভাইয়্যা,আমি ভেবেছিলাম.....।
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম মানুষের মতো মানুষ অনেক আছে বোন,মাঝে মাঝে আমারও এমন হয়।
এর পর আরও দু-একবার দেখা ও কথা হলেও শেষ দেখা করতে সেদিন ওদের বাসায় গেলাম। স্বামী-স্ত্রী আর তিন মেয়ে মিলে পাঁচ সদস্যের ছিমছাম পরিপাটি সংসার,বড় মেয়ে চম্পা,মেঝো মেয়ে রানী আর ছোট মেয়ে ইতি,পরপর তিনটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে হয়ত ক্লান্ত,শংকিত মনে আর কোন কন্যা সন্তানের মুখ দেখতে চায় না বলেই হয়তো ছোট মেয়েটার নাম ইতি রাখা হয়েছে। এত মায়া-মমতা আর ভালবাসায় মোড়ানো হৃদয়েও যে হতাশা আর অপ্রাপ্তি গুলো মানুষকে গোপনে কাঁদায় সেটা কারো কাছাকাছি না গেলে বোধ হয় বুঝাই যায় না।
একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে শিমুল,ফেরে রাত এগারোটায়, কোনদিন বারোটা। সরকারী চাকুরীর বয়স পেরিয়েছে সে কবেই। তাতে কি? কোম্পানিতেও বড় পদে মোটা বেতনে চাকুরী করার সুবিধার কথা শুনে চাকুরী জীবনে তিল-তিল করে জমানো সমুদয় টাকা বসের হাতে উৎকুচ দিয়েও যখন নিশ্চয়তা মিলে না তখন অর্পিতার সাধের গয়না বিকিয়ে আরো পঞ্চাশ হাজার টাকা জোগাড় করে আনন্দ-বেদনার দোলাচলে
বাড়ি ফিরে শিমুল,দরজায় মৃদু শব্দ করে,অর্পিতা দরজা খুলে দেয়। সে জেগেই ছিল এতক্ষন।
-কি ব্যাপার? তোমাকে এত বিষন্ন লাগছে কেন?
- ও কিছু না, তোমার সাধের গয়নাগুলো বিক্রি করে দিতে হয়েছেতো,তাই হয়তো...
-ওসব ভাবছো কেন? স্বামীর প্রয়োজনে যদি স্ত্রীর গয়না কাজেই না লাগে তবে সে গয়নার কোন মুল্যই থাকে না।
তাছাড়া চাকরিটা পেলে তুমি অনেক শাড়ী-গয়নাইতো দিতে পারবে আমায়।
- তা ঠিক বলেছো,কোন সামর্থবান স্বামীই চায় না তার স্ত্রীর গয়নাহীন অসুন্দর চেহারাটা দেখতে ।
সে রাতে ঘুমজড়ানো চোখে দুজনেই স্বপ্নমগ্ন রাত অতিবাহিত করে, বড় মাপের চাকুরী, অভাবহীন স্বচ্চন্দ জীবনে লালরঙা মোটর বাইকে চড়ে যমুনা সেতুর উপড় দিয়ে ঘুরে বেড়াবে দুজন দুজনার আরো আপন হয়ে,ভালবাসার গভীর মাখামাখি নিয়ে, রাজশাহী শহরের সেরা বিপণিবিতান থেকে সবচেয়ে দামী শাড়ী,চব্বিশ ক্যারেট খাঁটি সোনার গয়না পড়ে অভিজাত রমনীর মতো ছোট মেয়ের স্কুল গেটে অপেক্ষা করবে কখন ছুটির ঘন্টা বাজবে।
আমি এত লম্বা কাহিনী শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না মোটেও তার পরও কেন জানি পাথরের মুর্তির মতো নিশ্চুপ বসে কখনও হু- হ্যাঁ করে গল্পটা আয়ত্ব করেই চলেছি কেবল।এমন সময় চা নিয়ে হাজির বড় মেয়ে চম্পা,চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম
- বাঁকিটা না হয় ফোনেই শুনবো,আমার ট্রেন ছাড়তে আর বেশী দেরী নেই।
-লাস্ট ট্রেন ক'টায়?
- বললাম তিনটায়।
- লাস্ট ট্রেনে গেলে হয় না?
একটা দীর্ঘ নিশ্বাসের আওয়াজ ভেসে আসল কানে,মনে হলো কথাগুলো বলতে না পারলে হয়তো একটা কষ্ট থেকেই যাবে মনে। তাই তার কথায় সায় দিয়ে আবার মনযোগী হলামঃ যথাযথ প্রস্তুতি ছিল শিমুলের ইন্টারভিউ এর জন্য, যথানিয়মে পরীক্ষা হলো,লিখিত পরীক্ষায় ফাস্ট হলো শিমুল, আনন্দে আত্মহারা সবাই,কিন্ত যখন ভাইভা বোর্ড থেকে মলিন মুখে বেড়িয়ে আসে শিমুল, আমার স্বপ্নগুলো পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের খসে পড়া পলেস্তেরার মতো মাটিতে লুটাতে থাকে।
পরদিন সকালে দুর সম্পর্কের এক মামার পরামর্শে তাঁর সাথে হাজির হলাম নিয়োগ কমিটির সভাপতির বাসায়,
তখন রোজার সময় ছিল,কথার ফাঁকে তিনি কখনও মুড়ি চিবাচ্ছেন আবার কখনও চায়ে চুমুক,দেখেই বুঝেছিলাম দিন-দুপুরে দু-দুটি রোজাদারের সামনে যে বেহায়ার মতো মুড়ি চিবায়, তার কাছে মাথা ঠুঁকে কোন ফল হবে না। তার পরও মামার কথায় তার পায়ে পড়ে শিমুলের চাকরীর জন্য কেঁদেছিলাম ....।
আর বলতে পারে না অর্পিতা, চোখে তার সাতসাগরের জল,ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে,আমি চোখের জল মুছে শান্তনা দিতে চাই,ও বারণ করে,কাঁদো-কাঁদো কন্ঠে বলে উঠে-
চোখের জল মুছে কি হবে? বুকের ব্যাথা যদি না সাড়ে?
আমি হেরে গেলাম, এমন কথার কী জবাব দেব?কী সাধ্যই বা আমার আছে? আজকের পর হয়তো আর দেখাই হবে না আমাদের কারো সাথে কারোর। বদলীর অর্ডার যেহেতু হাতে, অতএব যত তাড়াতাড়ি নতুন কর্মস্থলে যোগদান করা যায় ততই ভালো।
অর্পিতা নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে-
পরদিন ফলাফল ঘোষিত হলো,শিমুল দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে,জানা গেল আরো বেশী উৎকুচ দিয়ে সার্টিফিকেটের জোর দেখিয়ে চাকরিটা ভাগিয়ে নিয়েছে সভাপতির নিকটাত্মীয় কেউ। আমি সেদিন খবরটা শুনে জ্ঞান হারিয়েছিলাম কয়েকবার। লজ্জায়,ঘৃনায়,অপমানে আমার মরে যেত ইচ্ছে করে,
বিশেষ করে পায়ে ধরার বিষয়টা মনে হলে লজ্জায় অপমানে মাথাটা হেট হয়ে যায়,ভাবছি সবার অগোচরে একদিন নিষ্ঠুর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো,আমি আত্মহত্যা করবো।
-ছিঃ এমন কথা বলো না। আমি তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম,আত্মহত্যা মানুষকে মুক্তি দিতে পারে না, ইহকাল পরকাল দুটোই নষ্ট করে দেয়।
নিজের কথা না হয় না-ই ভাবো, তোমার সন্তান সন্ততি,স্বামী-সংসার এসবের প্রয়োজনে তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে,ভেবে দেখতো তুমি না থাকলে এদের কি খারাপ অবস্থাই না হবে!
-ভেবে দেখবো নিশ্চয়ই।
অর্পিতা ভেতরের ঘর থেকে এক বাটি পায়েশে টেবিল চামচ ডুবিয়ে আমার সামনে পরিবেশন করতে করতে বললঃ কালিজিরা ধানের ঢেঁকিছাটা সুগন্ধি চালের পায়েশ, মা চাল পাঠিয়েছিলেন,শিমুল খুব পছন্দ করে তাই সকালে একটু করেছিলাম,একটু খেয়ে দেখেন অতৃপ্তি হবে না নিশ্চয়ই।
-ঠিক আছে খাবো তবে একটা কথা যে তোমাকে রাখতেই হবে;
-কী কথা?চোখে মুখে বিষ্ময় অর্পিতার।
-আগে বল রাখবে কি না?
-রাখবো।
আমি অফিসের কাগজপত্র আর ছোট ল্যাপটপ ভরা ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বললাম-
-মাথা থেকে আত্ম হননের জংলী ভূতটা নামিয়ে ফেলবে,আর কখনও,কোনো কারণে অমন পাপের কথা কল্পনাও করবে না।
-বল,কথা দিয়েছো?
-কথা দিলাম,তবে......
বাঁকী কথা আর শুনা হলো না,ত্রস্তপদে রাজশাহী
ষ্টেশনে এসে লাস্ট ট্রেনে চড়ে রওয়ানা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে, বন-বনানী,মাঠ-ঘাট,সবুজ ধানের ক্ষেত পেরিয়ে যমুনা সেতুর উপর দিয়ে ঝক ঝকা ঝক শব্দে ট্রেন চলছে আপন গতিতে,আমি জানালার ফাঁক দিয়ে যমুনার টলমল জল দেখছি আর ভাবছি অর্পিতার চোখের জল আর যমুনার জলের মাঝে কত তফাত?
ভাবছি,সে কি আমার কথা রাখবে? নাকি কেঁদে কেঁদে একদিন যমুনার জলে......আমি আর ভাবতে পারি না,নিজের অজানতেই দু ফোঁটা অশ্রু চোখের কোণে জমা হয়ে যায়.....।
- বাঁকিটা না হয় ফোনেই শুনবো,আমার ট্রেন ছাড়তে আর বেশী দেরী নেই।
-লাস্ট ট্রেন ক'টায়?
- বললাম তিনটায়।
- লাস্ট ট্রেনে গেলে হয় না?
একটা দীর্ঘ নিশ্বাসের আওয়াজ ভেসে আসল কানে,মনে হলো কথাগুলো বলতে না পারলে হয়তো একটা কষ্ট থেকেই যাবে মনে। তাই তার কথায় সায় দিয়ে আবার মনযোগী হলামঃ যথাযথ প্রস্তুতি ছিল শিমুলের ইন্টারভিউ এর জন্য, যথানিয়মে পরীক্ষা হলো,লিখিত পরীক্ষায় ফাস্ট হলো শিমুল, আনন্দে আত্মহারা সবাই,কিন্ত যখন ভাইভা বোর্ড থেকে মলিন মুখে বেড়িয়ে আসে শিমুল, আমার স্বপ্নগুলো পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের খসে পড়া পলেস্তেরার মতো মাটিতে লুটাতে থাকে।
পরদিন সকালে দুর সম্পর্কের এক মামার পরামর্শে তাঁর সাথে হাজির হলাম নিয়োগ কমিটির সভাপতির বাসায়,
তখন রোজার সময় ছিল,কথার ফাঁকে তিনি কখনও মুড়ি চিবাচ্ছেন আবার কখনও চায়ে চুমুক,দেখেই বুঝেছিলাম দিন-দুপুরে দু-দুটি রোজাদারের সামনে যে বেহায়ার মতো মুড়ি চিবায়, তার কাছে মাথা ঠুঁকে কোন ফল হবে না। তার পরও মামার কথায় তার পায়ে পড়ে শিমুলের চাকরীর জন্য কেঁদেছিলাম ....।
আর বলতে পারে না অর্পিতা, চোখে তার সাতসাগরের জল,ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে,আমি চোখের জল মুছে শান্তনা দিতে চাই,ও বারণ করে,কাঁদো-কাঁদো কন্ঠে বলে উঠে-
চোখের জল মুছে কি হবে? বুকের ব্যাথা যদি না সাড়ে?
আমি হেরে গেলাম, এমন কথার কী জবাব দেব?কী সাধ্যই বা আমার আছে? আজকের পর হয়তো আর দেখাই হবে না আমাদের কারো সাথে কারোর। বদলীর অর্ডার যেহেতু হাতে, অতএব যত তাড়াতাড়ি নতুন কর্মস্থলে যোগদান করা যায় ততই ভালো।
অর্পিতা নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে-
পরদিন ফলাফল ঘোষিত হলো,শিমুল দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে,জানা গেল আরো বেশী উৎকুচ দিয়ে সার্টিফিকেটের জোর দেখিয়ে চাকরিটা ভাগিয়ে নিয়েছে সভাপতির নিকটাত্মীয় কেউ। আমি সেদিন খবরটা শুনে জ্ঞান হারিয়েছিলাম কয়েকবার। লজ্জায়,ঘৃনায়,অপমানে আমার মরে যেত ইচ্ছে করে,
বিশেষ করে পায়ে ধরার বিষয়টা মনে হলে লজ্জায় অপমানে মাথাটা হেট হয়ে যায়,ভাবছি সবার অগোচরে একদিন নিষ্ঠুর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো,আমি আত্মহত্যা করবো।
-ছিঃ এমন কথা বলো না। আমি তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম,আত্মহত্যা মানুষকে মুক্তি দিতে পারে না, ইহকাল পরকাল দুটোই নষ্ট করে দেয়।
নিজের কথা না হয় না-ই ভাবো, তোমার সন্তান সন্ততি,স্বামী-সংসার এসবের প্রয়োজনে তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে,ভেবে দেখতো তুমি না থাকলে এদের কি খারাপ অবস্থাই না হবে!
-ভেবে দেখবো নিশ্চয়ই।
অর্পিতা ভেতরের ঘর থেকে এক বাটি পায়েশে টেবিল চামচ ডুবিয়ে আমার সামনে পরিবেশন করতে করতে বললঃ কালিজিরা ধানের ঢেঁকিছাটা সুগন্ধি চালের পায়েশ, মা চাল পাঠিয়েছিলেন,শিমুল খুব পছন্দ করে তাই সকালে একটু করেছিলাম,একটু খেয়ে দেখেন অতৃপ্তি হবে না নিশ্চয়ই।
-ঠিক আছে খাবো তবে একটা কথা যে তোমাকে রাখতেই হবে;
-কী কথা?চোখে মুখে বিষ্ময় অর্পিতার।
-আগে বল রাখবে কি না?
-রাখবো।
আমি অফিসের কাগজপত্র আর ছোট ল্যাপটপ ভরা ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বললাম-
-মাথা থেকে আত্ম হননের জংলী ভূতটা নামিয়ে ফেলবে,আর কখনও,কোনো কারণে অমন পাপের কথা কল্পনাও করবে না।
-বল,কথা দিয়েছো?
-কথা দিলাম,তবে......
বাঁকী কথা আর শুনা হলো না,ত্রস্তপদে রাজশাহী
ষ্টেশনে এসে লাস্ট ট্রেনে চড়ে রওয়ানা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে, বন-বনানী,মাঠ-ঘাট,সবুজ ধানের ক্ষেত পেরিয়ে যমুনা সেতুর উপর দিয়ে ঝক ঝকা ঝক শব্দে ট্রেন চলছে আপন গতিতে,আমি জানালার ফাঁক দিয়ে যমুনার টলমল জল দেখছি আর ভাবছি অর্পিতার চোখের জল আর যমুনার জলের মাঝে কত তফাত?
ভাবছি,সে কি আমার কথা রাখবে? নাকি কেঁদে কেঁদে একদিন যমুনার জলে......আমি আর ভাবতে পারি না,নিজের অজানতেই দু ফোঁটা অশ্রু চোখের কোণে জমা হয়ে যায়.....।