রিক্সাটি
===============রিফাহ রায়হানা
================
ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই আজানের ধ্বনির সাথে সাথেই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ও। ওর নামটা আমি ঠিক জানি না। বেশিরভাগ মানুষই মিয়া বলে ডাকে। সম্ভবত রিকসাচালককে মিয়া উপাধি দেওয়া হয়।
লোকটা খুব ভালো। আমার যত্ন নেয়। কিন্তু একটা বিষয় বুঝি না, ও আজানের সাথে সাথে রিকসা চালানোর জন্য বের হয়। নামায ১০ মিনিটেই পড়া যায়। কিন্তু ও পড়ে না। ওর কাছে আয় করাটা বেশি জরুরি। বলতে পারলে ঠিকই বলতাম নামায পড়ো।
প্রায় ৫ বছর আমরা একসাথে কাজ করি। আমাকে ও চালায় আর আমি চলি। সারাদিন চালিয়ে চালিয়ে ও ক্লান্ত হলেও আমি হই না। মাঝে মাঝে চাকা পাংচার হলে ঠিক করিয়ে নেয়। কখনো কখনো হুডটাও ভেঙ্গে যায়। তাও ঠিক করিয়ে ও আমাকে সুন্দর রাখে। ৩ বছর আগে ও আমাকে কিনেছিল। আগের ২ বছর আমাকেই ভাড়া নিয়ে চালাত। আমাকে কেনার পরই নতুন করে রং করিয়ে একজনকে দিয়ে অনেক সুন্দর ছবি আঁকিয়েছিল পিছনে। হুডে প্লাস্টিকের ঝালরও লাগিয়েছিল। তখন অনেক সুন্দর হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
আজকে রাস্তায় নেমে তেমন কোন যাত্রী পেল না ও। কিন্তু দুপুরের পরই অনেক ছাত্রছাত্রী দেখা গেল রাস্তা আর ফুটপাতে। স্কুলে যাচ্ছে। তিনজন ছাত্রী একসাথে আমার উপর বসল। কষ্ট খুব একটা হলো না, অভ্যাস আছে। তাদের গল্প শুনে বুঝলাম আজকে কোনো বোর্ড পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। তাই তাদের আনন্দ উৎসব, নিশ্চয় তারা ভাল করেছে। একজন আর একজনকে বলল, “কী রে তোর মিষ্টি কই?”
“বাসায় আয়, পেয়ে যাবি।” উত্তর দিল অন্যজন।
কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগল, ভাল রেজাল্টে মিষ্টিই কেন খাওয়ায় বা খায়? ঝাল বা নোনতাও তো খাওয়াতে পারে। আমার ঝাল ঝাল ঘ্রাণটা বেশ ভাল লাগে। খেতে পারি না দেখে ঝাল মিষ্টি কোনটারই স্বাদ বুঝি না। কিন্তু ঘ্রাণ বুঝি, আর সে অনুযায়ী মিষ্টির কোন ঘ্রাণই পাই না। নানা রকম হোটেল থেকে আসা ঝাল ঝাল ঘ্রাণ অনেক লোভনীয় হয়। কিন্তু এসব বোঝানোর কোনো উপায়ই আমার নেই।
সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় কত ঘটনার যে সাক্ষী আমি হই তার হিসেব নেই। ওই তো একদিন, সলিমুল্লাহ হলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎই পাশের রিক্সার যাত্রীর হাঁটুতে একটা গাছের শুকনো ডাল ভেঙ্গে পড়েছিল। চিৎকারেই বোঝ গিয়েছিল অনেক ব্যাথা পেয়েছিল। গাছগুলো শতবর্ষ পুরোনো হওয়ায় এরকম দুর্ঘটনার ভয় থাকেই। ভাগ্যিস লোকটার মাথায় পড়ে নি।
এ বছরের শুরুতেই আমিও খুব ব্যাথা পেয়েছিলাম। জানুয়ারি না ফেব্রুয়ারি মাস চলছিল। সেদিনও অন্যান্য দিনের মতো ও আমাকে নিয়ে ভোরে বের হয়েছিল। মেইন রোডে আসতেই দেখা গেল একটা মিছিল হচ্ছে। মিছিলটা এদিকেই আসছে দেখে ও আমাকে একটা দোকানের পাশে দাঁড় করাল। দোকানপাট সব বন্ধ ছিল। মিছিলের মনুষ ছাড়া কোন মানুষও ছিল না।
কিছুক্ষণ! এরই মধ্যে কী থেকে কী হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারলাম না। মারামারি, হই-চই চারিদিকে। ও আমার পিছনে দাঁড়িয়ে যেন একটু নিরাপত্তা চাইল। হঠাৎই একটা ছেলে মানে যুবক এসে আমাকে পেটালো। তারপর উল্টে ফেলে ছিল। অনেক ব্যাথ্যা পেয়েছিলাম। প্যাডেল আর হুকটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। খুঁটিনাটিসহ সব ঠিক হতে প্রায় আড়াই দিন সময় লাগল। খরচও হল অনেক। ও অবশ্য কোন ব্যাথা পায় নি, কিন্তু খুব কষ্ট পেয়েছিল। এরপর প্রায় একমাসের মতো ও আমাকে নিয়ে দুপুরের পর বের হত আর সন্ধ্যার সাথে সাথেই বাড়ি ফিরত।
কিছুদিন পর একদিন।
আজানের আগেই ও আমাকে নিয়ে বের হল। পাঁচটা বাজে, হঠাৎ মাটি কেমনভাবে যেন কেঁপে উঠল। সে কাঁপন এমন ছিল যা আমাকেও ভেতর-বাহির থেকে কাঁপিয়ে দিল। ও ভয়ে আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আমার কাছে মাটির চেয়ে ওর হাতের কাঁপুনির মাত্রা বেশি মনে হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই অদ্ভূত, আর ভয়ঙ্কর কাঁপুনি থেমে গেল, কিন্তু চারিদিকে একটা পরিবর্তন হল। আশেপাশের আভিজাত বিল্ডিংয়ের বেশিরভাগ মানুষই নিচে নেমে এল। অনেকে তো আমার চারপাশে আমাকে ধরে দাঁড়াল। সবার কথাবার্তায় বুঝলাম ভূমিকম্প হয়েছে। চারিদিকের সবকিছু দেখে আমি খুবই আশ্চর্য হলাম আর একটা গভীর বিষয় উপলব্ধি করলাম। মানুষ- তার ক্ষমতা বা অর্থের কত দাপট! আর এই দাপটে সে নিজেকে অনেক উঁচুতে বসিয়ে রাখে। কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডের কাঁপুনি তাকে রাস্তায় নামিয়ে আনল। মানুষের প্রাণের কী মায়া! কী ভয়! এই সময় তার ক্ষমতা বা অর্থের দাপট কোথায় যায়? সেইতো রিকসাচালকের সাথে দাঁড়িয়ে পড়ল নিঃসংকোচে, যাকে অন্য সময় কত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে।
হঠাৎ একজন বলল, “এই চল, নিচে যখন নেমেছিই, নামাযটা পড়ে আসি। যা ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হল...।”
“হ্যা, চল। মসজিদতো কাছেই।” অন্য একজন উত্তর দিল।
তারপর কয়েকজন মিলে নামায পড়তে গেল। এদের দেখাদেখি আরও কয়েকজন সম্মানীয় ব্যক্তি নামায পড়তে গেলেন।
ঘটনাটা দেখে, হাসতে পারলে অবশ্যই হাসতাম। কী অকৃতজ্ঞ মানুষ! বিপদে পড়েছে তাই প্রার্থনা। বিপদ শেষ, ভয় শেষ, এসবও শেষ। ভূমিকম্প না হলে এরা সবাই ঘুমাত এখন। কজনই বা নামায পড়ত? হাতে গোনা কয়েকজন। আমার তো মনে হল আল্লাহতায়ালা মানুষকে জাগানোর জন্যই, সচেতন করার জন্যই একটু ঝাঁকি দিয়ে দিলেন, যাতে সুখনিদ্রা ত্যাগ করে নামায পড়ে।
এ ঘটনার পর ও খুব ভয় পেয়ে গেল।
এখন ঠিকই আজানের পর নামায পড়ে বেরোয়। আজও বের হওয়ার সময় নামায পড়ে নিল ও। আকাশটা মেঘলা ছিল। চারিদিকে অন্ধকার। বর্ষা চলছে। এ সময় আমার চলতে কষ্ট হয়। রাস্তা ভর্তি পানি থাকে। আজ বের হওয়ার পরপরই বৃষ্টি শুরু হল। কী তুমুল বৃষ্টি! ও একটা পলিথিন দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। যাত্রী খুব কম। যাত্রী ছাড়া ও চালাচ্ছিল আর আমি চলছিলাম একটা বড়ো রাস্তা দিয়ে। তখনো বৃষ্টি পড়ছে, তবে মাত্রা একটু কম। রাস্তায় এত পানি জমেছে যে, আমার সিটের একটু নিচ থেকে পুরোটা পানির ভিতর। কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে বলেই এ অবস্থা। কিন্তু আমার এ অবস্থা একটুও ভাল লাগে না। পানিও যা নোংরা হয়। এক্কেবারে মাটির রং। আবার কত কিছু ভাসে। ওরও চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। পা দুটোই যে পানির নিচে।
এ সময়টা মনে হয় দশটা কী এগারোটা। সময় বোঝার উপায় নেই। দুপুর হয় নি এটা নিশ্চিত; যোহরের আজান দেয় নি। চলতে চলতে হঠাৎই আমার ডান চাকাসহ ডান দিকটা একটা গর্তে ঢুকে গেল। ওটা সম্ভবত ম্যানহোল ছিল এবং অনেক বড়। কারণ আমার ডান দিক ঢুকে পড়ার সাথে সাথেই হুডসহ অনেকখানিই ঢুকে গেল। সাথে সাথেই ও পড়ে গেল ম্যানহোলের ভিতরে, আমার সামনের দিক নিয়ে। চারিদিকে বাড়ি খেতে খেতে দেখলাম ওর মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে আর মিশে যাচ্ছে পানির সাথে। ও পড়ে যাচ্ছে আর শেষ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কিছু কথাবর্তা শুনতে পেলাম। “এই... একটা রিকসা পড়ে গেল যে। চালকটাওতো ডুবে গেল। কেউ ধরো...।”
“আরে ভাই, কে ধরবে? সে নিজেই উঠতে পারবে। চলেন তো, বাসায় যেতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজে জমে গেলাম।” সাথের কেউ একজন উত্তর দিল।
গভীরতা আর অন্ধকারের ঘনত্বে আর কিছুই বুঝলাম না, শুধু উপলব্ধি করলাম কেউ সাহায্য করার নেই। কেউ নেই। আমি অনুভব করলাম আমার হুড, প্যাডেল, হ্যান্ডেল আর চেইন আলাদা হয়ে যাচ্ছে। পড়ে যে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়েছিলাম। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার ব্যাথার চেয়ে ওর চলে যাওয়াটা আমাকে বেশি ব্যাথা দিল। মুহূর্তের মধ্যেই ও ওর সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে চলে গেল। রাস্তায় জমা পানিতে ডুবে নাকি খোলা ম্যানহোলে পড়ে? জানি না, কারণ আমিও ভেঙ্গে যাচ্ছিলাম...!
#
০৬-০১-২০১৬
লোকটা খুব ভালো। আমার যত্ন নেয়। কিন্তু একটা বিষয় বুঝি না, ও আজানের সাথে সাথে রিকসা চালানোর জন্য বের হয়। নামায ১০ মিনিটেই পড়া যায়। কিন্তু ও পড়ে না। ওর কাছে আয় করাটা বেশি জরুরি। বলতে পারলে ঠিকই বলতাম নামায পড়ো।
প্রায় ৫ বছর আমরা একসাথে কাজ করি। আমাকে ও চালায় আর আমি চলি। সারাদিন চালিয়ে চালিয়ে ও ক্লান্ত হলেও আমি হই না। মাঝে মাঝে চাকা পাংচার হলে ঠিক করিয়ে নেয়। কখনো কখনো হুডটাও ভেঙ্গে যায়। তাও ঠিক করিয়ে ও আমাকে সুন্দর রাখে। ৩ বছর আগে ও আমাকে কিনেছিল। আগের ২ বছর আমাকেই ভাড়া নিয়ে চালাত। আমাকে কেনার পরই নতুন করে রং করিয়ে একজনকে দিয়ে অনেক সুন্দর ছবি আঁকিয়েছিল পিছনে। হুডে প্লাস্টিকের ঝালরও লাগিয়েছিল। তখন অনেক সুন্দর হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
আজকে রাস্তায় নেমে তেমন কোন যাত্রী পেল না ও। কিন্তু দুপুরের পরই অনেক ছাত্রছাত্রী দেখা গেল রাস্তা আর ফুটপাতে। স্কুলে যাচ্ছে। তিনজন ছাত্রী একসাথে আমার উপর বসল। কষ্ট খুব একটা হলো না, অভ্যাস আছে। তাদের গল্প শুনে বুঝলাম আজকে কোনো বোর্ড পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। তাই তাদের আনন্দ উৎসব, নিশ্চয় তারা ভাল করেছে। একজন আর একজনকে বলল, “কী রে তোর মিষ্টি কই?”
“বাসায় আয়, পেয়ে যাবি।” উত্তর দিল অন্যজন।
কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগল, ভাল রেজাল্টে মিষ্টিই কেন খাওয়ায় বা খায়? ঝাল বা নোনতাও তো খাওয়াতে পারে। আমার ঝাল ঝাল ঘ্রাণটা বেশ ভাল লাগে। খেতে পারি না দেখে ঝাল মিষ্টি কোনটারই স্বাদ বুঝি না। কিন্তু ঘ্রাণ বুঝি, আর সে অনুযায়ী মিষ্টির কোন ঘ্রাণই পাই না। নানা রকম হোটেল থেকে আসা ঝাল ঝাল ঘ্রাণ অনেক লোভনীয় হয়। কিন্তু এসব বোঝানোর কোনো উপায়ই আমার নেই।
সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় কত ঘটনার যে সাক্ষী আমি হই তার হিসেব নেই। ওই তো একদিন, সলিমুল্লাহ হলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎই পাশের রিক্সার যাত্রীর হাঁটুতে একটা গাছের শুকনো ডাল ভেঙ্গে পড়েছিল। চিৎকারেই বোঝ গিয়েছিল অনেক ব্যাথা পেয়েছিল। গাছগুলো শতবর্ষ পুরোনো হওয়ায় এরকম দুর্ঘটনার ভয় থাকেই। ভাগ্যিস লোকটার মাথায় পড়ে নি।
এ বছরের শুরুতেই আমিও খুব ব্যাথা পেয়েছিলাম। জানুয়ারি না ফেব্রুয়ারি মাস চলছিল। সেদিনও অন্যান্য দিনের মতো ও আমাকে নিয়ে ভোরে বের হয়েছিল। মেইন রোডে আসতেই দেখা গেল একটা মিছিল হচ্ছে। মিছিলটা এদিকেই আসছে দেখে ও আমাকে একটা দোকানের পাশে দাঁড় করাল। দোকানপাট সব বন্ধ ছিল। মিছিলের মনুষ ছাড়া কোন মানুষও ছিল না।
কিছুক্ষণ! এরই মধ্যে কী থেকে কী হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারলাম না। মারামারি, হই-চই চারিদিকে। ও আমার পিছনে দাঁড়িয়ে যেন একটু নিরাপত্তা চাইল। হঠাৎই একটা ছেলে মানে যুবক এসে আমাকে পেটালো। তারপর উল্টে ফেলে ছিল। অনেক ব্যাথ্যা পেয়েছিলাম। প্যাডেল আর হুকটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। খুঁটিনাটিসহ সব ঠিক হতে প্রায় আড়াই দিন সময় লাগল। খরচও হল অনেক। ও অবশ্য কোন ব্যাথা পায় নি, কিন্তু খুব কষ্ট পেয়েছিল। এরপর প্রায় একমাসের মতো ও আমাকে নিয়ে দুপুরের পর বের হত আর সন্ধ্যার সাথে সাথেই বাড়ি ফিরত।
কিছুদিন পর একদিন।
আজানের আগেই ও আমাকে নিয়ে বের হল। পাঁচটা বাজে, হঠাৎ মাটি কেমনভাবে যেন কেঁপে উঠল। সে কাঁপন এমন ছিল যা আমাকেও ভেতর-বাহির থেকে কাঁপিয়ে দিল। ও ভয়ে আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আমার কাছে মাটির চেয়ে ওর হাতের কাঁপুনির মাত্রা বেশি মনে হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই অদ্ভূত, আর ভয়ঙ্কর কাঁপুনি থেমে গেল, কিন্তু চারিদিকে একটা পরিবর্তন হল। আশেপাশের আভিজাত বিল্ডিংয়ের বেশিরভাগ মানুষই নিচে নেমে এল। অনেকে তো আমার চারপাশে আমাকে ধরে দাঁড়াল। সবার কথাবার্তায় বুঝলাম ভূমিকম্প হয়েছে। চারিদিকের সবকিছু দেখে আমি খুবই আশ্চর্য হলাম আর একটা গভীর বিষয় উপলব্ধি করলাম। মানুষ- তার ক্ষমতা বা অর্থের কত দাপট! আর এই দাপটে সে নিজেকে অনেক উঁচুতে বসিয়ে রাখে। কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডের কাঁপুনি তাকে রাস্তায় নামিয়ে আনল। মানুষের প্রাণের কী মায়া! কী ভয়! এই সময় তার ক্ষমতা বা অর্থের দাপট কোথায় যায়? সেইতো রিকসাচালকের সাথে দাঁড়িয়ে পড়ল নিঃসংকোচে, যাকে অন্য সময় কত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে।
হঠাৎ একজন বলল, “এই চল, নিচে যখন নেমেছিই, নামাযটা পড়ে আসি। যা ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হল...।”
“হ্যা, চল। মসজিদতো কাছেই।” অন্য একজন উত্তর দিল।
তারপর কয়েকজন মিলে নামায পড়তে গেল। এদের দেখাদেখি আরও কয়েকজন সম্মানীয় ব্যক্তি নামায পড়তে গেলেন।
ঘটনাটা দেখে, হাসতে পারলে অবশ্যই হাসতাম। কী অকৃতজ্ঞ মানুষ! বিপদে পড়েছে তাই প্রার্থনা। বিপদ শেষ, ভয় শেষ, এসবও শেষ। ভূমিকম্প না হলে এরা সবাই ঘুমাত এখন। কজনই বা নামায পড়ত? হাতে গোনা কয়েকজন। আমার তো মনে হল আল্লাহতায়ালা মানুষকে জাগানোর জন্যই, সচেতন করার জন্যই একটু ঝাঁকি দিয়ে দিলেন, যাতে সুখনিদ্রা ত্যাগ করে নামায পড়ে।
এ ঘটনার পর ও খুব ভয় পেয়ে গেল।
এখন ঠিকই আজানের পর নামায পড়ে বেরোয়। আজও বের হওয়ার সময় নামায পড়ে নিল ও। আকাশটা মেঘলা ছিল। চারিদিকে অন্ধকার। বর্ষা চলছে। এ সময় আমার চলতে কষ্ট হয়। রাস্তা ভর্তি পানি থাকে। আজ বের হওয়ার পরপরই বৃষ্টি শুরু হল। কী তুমুল বৃষ্টি! ও একটা পলিথিন দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। যাত্রী খুব কম। যাত্রী ছাড়া ও চালাচ্ছিল আর আমি চলছিলাম একটা বড়ো রাস্তা দিয়ে। তখনো বৃষ্টি পড়ছে, তবে মাত্রা একটু কম। রাস্তায় এত পানি জমেছে যে, আমার সিটের একটু নিচ থেকে পুরোটা পানির ভিতর। কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে বলেই এ অবস্থা। কিন্তু আমার এ অবস্থা একটুও ভাল লাগে না। পানিও যা নোংরা হয়। এক্কেবারে মাটির রং। আবার কত কিছু ভাসে। ওরও চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। পা দুটোই যে পানির নিচে।
এ সময়টা মনে হয় দশটা কী এগারোটা। সময় বোঝার উপায় নেই। দুপুর হয় নি এটা নিশ্চিত; যোহরের আজান দেয় নি। চলতে চলতে হঠাৎই আমার ডান চাকাসহ ডান দিকটা একটা গর্তে ঢুকে গেল। ওটা সম্ভবত ম্যানহোল ছিল এবং অনেক বড়। কারণ আমার ডান দিক ঢুকে পড়ার সাথে সাথেই হুডসহ অনেকখানিই ঢুকে গেল। সাথে সাথেই ও পড়ে গেল ম্যানহোলের ভিতরে, আমার সামনের দিক নিয়ে। চারিদিকে বাড়ি খেতে খেতে দেখলাম ওর মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে আর মিশে যাচ্ছে পানির সাথে। ও পড়ে যাচ্ছে আর শেষ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কিছু কথাবর্তা শুনতে পেলাম। “এই... একটা রিকসা পড়ে গেল যে। চালকটাওতো ডুবে গেল। কেউ ধরো...।”
“আরে ভাই, কে ধরবে? সে নিজেই উঠতে পারবে। চলেন তো, বাসায় যেতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজে জমে গেলাম।” সাথের কেউ একজন উত্তর দিল।
গভীরতা আর অন্ধকারের ঘনত্বে আর কিছুই বুঝলাম না, শুধু উপলব্ধি করলাম কেউ সাহায্য করার নেই। কেউ নেই। আমি অনুভব করলাম আমার হুড, প্যাডেল, হ্যান্ডেল আর চেইন আলাদা হয়ে যাচ্ছে। পড়ে যে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়েছিলাম। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার ব্যাথার চেয়ে ওর চলে যাওয়াটা আমাকে বেশি ব্যাথা দিল। মুহূর্তের মধ্যেই ও ওর সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে চলে গেল। রাস্তায় জমা পানিতে ডুবে নাকি খোলা ম্যানহোলে পড়ে? জানি না, কারণ আমিও ভেঙ্গে যাচ্ছিলাম...!
#
০৬-০১-২০১৬