জিনের বাদশা
ফরিদপুর জেলায় ‘আরিয়ল খাঁ’ নদীর ধারে ছোট্ট গ্রাম। নাম মোহনপুর। অধিকাংশ অধিবাসীই চাষি মুসলমান। গ্রামের একটেরে ঘরকতক কায়স্থ। যেন ছোঁয়াচের ভয়েই ওরা একটেরে গিয়ে ঘর তুলেছে।
তুর্কি ফেজের উপরের কালো ঝাণ্ডিটা যেমন হিন্দুত্বের টিকির সাথে আপস করতে চায়, অথচ হিন্দুর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পারে না, তেমনই গ্রামের মুসলমানেরা কায়স্থপাড়ার সঙ্গে ভাব করতে গেলেও কায়স্থ-পাড়া কিন্তু ওটাকে ভূতের বন্ধুত্বের মতোই ভয় করে।
গ্রামের মুসলমানদের মধ্যে চুন্নু ব্যাপারী মাতব্বর লোক। কিন্তু মাতব্বর হলেও সে নিজে হাতেই চাষ করে। সাহায্য করে তার সাতটি ছেলে এবং তিনটি বউ। কেন যে সে আর একটি বউ এনে সুন্নত আদায় করেনি, তা সে-ই জানে। লোকে কিন্তু বলে, তার তৃতীয় পক্ষটি একেবারে ‘খর-দজ্জাল’ মেয়ে। এরই শতমুখী অস্ত্রের ভয়ে চতুর্থ পক্ষ নাকি ও-বাড়ি মুখো হতে পারেনি। এর জন্য চুন্নু ব্যাপারীর আপশোশের আর অন্ত ছিল না। সে প্রায়ই লোকের কাছে দুঃখ করে বলত, ‘আরে, এরেই কয় – খোদায় দেয় তো জোলায় দেয় না! আল্লা মিয়াঁ তো হুকুমই দিছেন চারড্যা বিবি আনবার, তা কপালে নাই, ওইব কোহান থ্যা!’ বলেই একটু ঢোক গিলে আবার বলে, ‘ওই বিজাত্যার বেডিরে আন্যাই না এমনডা ওইল!’ বলেই আবার কিন্তু সাবধান করে দেয়, ‘দেহিয়ো বাপু, বারিত গিয়া কইয়্যা দিয়ো না। হে বেডি হুনল্যা এক্কেরে দুপুর্যা মাতম লাগাইয়া দিব!’
এই তৃতীয় পক্ষেরই তৃতীয় সন্তান ‘আল্লারাখা’ আমাদের গল্পের নায়ক। গল্পের নায়কের মতোই দুঃশীল, দুঃসাহসী, দুঁদে ছেলে সে। গ্রামে কিন্তু এর নাম ‘কেশরঞ্জন বাবু’। এ নাম এর প্রথম দেয় ওই গ্রামের একটি মেয়ে। নাম তার ‘চান ভানু’ অর্থাৎ চাঁদ বানু। সে কথা পরে বলছি।
চুন্নু ব্যাপারীর তৃতীয় পক্ষের দুই-দুইবার মেয়ে হবার পর তৃতীয় দফায় যখন পুত্র এল, তখন সাবধানী মা তার নাম রাখলে আল্লারাখা। আল্লাকে রাখতে দেওয়া হল যে ছেলে, অন্তত তার অকালমৃত্যু সম্বন্ধে – আর কেউ না হোক মা তার নিশ্চিন্ত হয়ে রইল। আল্লা হয়তো সেদিন প্রাণ ভরে হেসেছিলেন। অমন বহু ‘আল্লারাখা’কে আল্লা ‘গোরস্থান-রাখা’ করেছেন, কিন্তু এর বেলায় যেন রসিকতা করেই একে সত্যিসত্যিই জ্যান্ত রাখলেন! মনে মনে বললেন, ‘দাঁড়া, ওকে বাঁচিয়ে রাখব, কিন্তু তোদের জ্বালিয়ে মেরে ছাড়ব!’ সে পরে মরবে কিনা জানি না, কিন্তু এই বিশটে বছর যে সে বেঁচে আছে, তার প্রমাণ গাঁয়ের লোক হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। তার বেঁচে থাকাটা প্রমাণ করার বহর দেখে গাঁয়ের লোক বলাবলি করে, ও গুয়োটা আল্লারাখা না হয়ে যদি মামদোভূত হত, তা হলেও বরং ছিল ভালো। ভূতেও বুঝি এত জ্বালাতন করতে পারে না!
ওকে মুসলমানরা বলত, ‘ইবলিশের
পোলা’, কায়েতরা বলত, ‘অমাবস্যার জম্মিৎ !’ বাপ বলত, ‘হালার পো’, মা আদর করে বলত – ‘আফলাতুন !’
এইবার যে মেয়েটির কল্যাণে ওর নাম কেশরঞ্জন বাবু হয়, সেই চানভানুর একটু পরিচয় দিই।
মেয়েটি ওই গাঁয়েরই নারদ আলি শেখের। নারদ আলি নামটা হিন্দু-মুসলমান মিলনের জন্য রাখা নয়। নারদ আলি অসহযোগ আন্দোলনের অনেক আগের মানুষ। অসহযোগ আন্দোলন যদ্দিনের, তা ওর হাঁটুর বয়েস! বাম পায়ের হাঁটুর বয়েস! বাম পায়ের হাঁটু আর বললাম না, ওটা অতিরঞ্জন হবে!
নারদ আলি, শেখ রামচন্দ্র, সীতা বিবি প্রভৃতি নাম এখনও গাঁয়ে দশ-বিশটে পাওয়া যায়। অবশ্য হনুমানুল্লা, বিষ্ণু হোসেন প্রভৃতি নামও আছে কিনা জানিনে।
নারদ আলি গাঁয়ের মাতব্বর না হলেও অবস্থা ওর মন্দ নয়। যা জমি-জায়গা আছে তার, তারই উৎপন্ন ফসলে দিব্যি বছর কেটে যায়। ও কারুর ধারও ধারে না, কাউকে ধার দেয়ও না।
দিব্যি শান্তশিষ্ট মানুষটি! কিন্তু ওর বউটি ঝগড়া-কাজিয়া না করলেও কাজিয়ার ভান করে যে মজা করে, তা অন্তত নারদ আলির কাছে একটু অশান্তিকর বলেই মনে হয়। লোক খ্যাপানো বউটার স্বভাব। কিন্তু সে রসিকতা বুঝতে না পেরে অপর পক্ষ যখন খেপে ওঠে, তখন সে বেশ কিছুক্ষণ কোঁদল করার ভান করে হঠাৎ মাঝ উঠানে ধামাচাপা দিয়ে বলে ওঠে, ‘আজ রইল কাজিয়া ধামাচাপা, খাইয়া লইয়া আই, তারপর তোরে, দেখাইব মজাডা! এই ধামারে যে খুলব, তার লল্লাটে আল্লা ভাসুরের সাথে নিকা লিখছে!’ বলেই এমন ভঙ্গির সাথে সে ধামাটা চাপা দেয়, এবং কথাগুলো বলে যে, অন্য লোকের সাথে – যে ঝগড়া করছিল সেও হেসে ফেলে! অবশ্য, রাগ তাতে তার কমে না।
এদেরই একটি মাত্র সন্তান চানভানু। পুথির কেসসা শুনে মায়ের আদর করে রাখা নাম!
চানভানু যেন তার মায়েরই ঈষৎ পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ! চোখে মুখে কথা কয়, ঘাটে মাঠে ছুটোছুটি করে, আরিয়ল খাঁর দল ওর ভয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে চায়!
চোদ্দো বছর বয়স হয়ে গেল, অথচ বাপে বললেও মায়ে বিয়ের নাম করতে দেয় না। বলে, চান চলে গেলে থাকব কি করে আঁধার পুরীতে। নারদ আলি বেশি কিছু বললে বউ তার তাড়া দিয়ে বলে ওঠে, ‘তোমার খ্যাচ-খ্যাচাইবার ওইব না, আমার মাইয়্যা বিয়া বসব না – জৈগুন বিবির লাহান উয়ার হানিপ যদ্দিন না আয়ে!’
মোহনপুরের জৈগুন বিবি – চানভানুর ‘হানিফ’ বীরের কিন্তু আসতে দেরি হল না এবং সে হানিফ আমাদের আল্লারাখা।
একদিন হঠাৎ আল্লারাখার ‘সোনাভানের’র পুথি পড়তে পড়তে মনে হল, চানভানুই সে সোনাভানবিবি এবং সে গাজি হানিফা। তার কারণ, চানের চেয়ে সুন্দরী মেয়ে গাঁয়ে ছিল না। সে সোনাভান বিজয়ের জন্য জয়-যাত্রার চিন্তা করতে করতে পড়ে যেতে লাগল –
‘হানিফার আওয়াজ বিবি শুনিল যখন,
নাসতা করিয়া নিল থোড়া আশি মন।
লক্ষ মনের গোর্জ
বিবির হাজার মনের ঢাল,
বারো ঘোড়ায় চড়ে বলে তুলব পিঠের খাল!’
বাপপুরে! এ যে হানিফার বাবা! এ আবার আশি মন নাশতা করে, বারোটা ঘোড়ায় এক সাথে চড়ে! চানভানুও ওই রকম কিছু করবে নাকি? আল্লারাখা রীতিমতো হকচকিয়ে গেল। কিন্তু হেরে হেরেও তো হানিফাই শেষে কেল্লা-ফতে করেছিলেন! যা থাকে কপালে! আল্লারাখা তার বাবরি চুলের মাঝে একটা এবং দুদিকে দুটো – এই তিন তিনটে সিঁথি কেটে, চুলে, গায়ে, ময় জামায় বেশ করে কেশরঞ্জন মেখে, গালে বেশ করে পান ঠুসে সোনাভান ওরফে চানভানুকে জয় করতে বেরিয়ে পড়ল।
এইখানে বলে রাখি, আমাদের আল্লারাখা পুথি পড়ে যতদূর আধুনিক হবার – তা হয়ে উঠেছিল। সে ঠিক চাষার ছেলের মতো থাকত না, পরিষ্কার ধুতি-জামা-জুতো পরে লম্বা চুলে তেড়ি কেটে, পান সিগারেট খেতে খেতে গাঁয়ের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিত এবং কার কি অনিষ্ট করবে তারই মতলব আঁটত। কিন্তু বয়স তার যৌবনের ‘ফ্রন্টিয়ার’ ক্রস করলেও মেয়েদের ওপর কোনো অত্যাচার কোনোদিন করেনি। তার টার্গেট ছিল বেশিরভাগ বুড়ো-বুড়ির দল ; বাড়ির, মাঠের ফল-ফসল ; গাছের আগা, ঘরের মটকা এবং রাত্রে বাঁশঝাড়, তেঁতুল গাছ, তালগাছ ইত্যাদি।
অকারণে বলদ ঠ্যাঙানো বা তাদের দড়ি খুলে দিয়ে বাবাকে লোকের গাল খাওয়ানো ছাড়া বাবার চাষবাসে অন্য বিশেষ সহায়তা সে করেনি। দু-বার সে মাঠ তদারক করতে গেছিল, তাতে একবার মাঠের পাকা ধানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, আর একবার সমস্ত ধান কেটে অন্যের খেতে রেখে এসেছিল। এর পর তার বাবা আর তাকে সাহায্য করতে ডাকেনি।
তার বিলাসিতার টাকা যখন তার মা একদিন বন্ধ করলে এবং বাবার কাছে চেয়েও তার বাবা যখন ওরই বদলে গড়পড়তা হিসেব করে তার পৃষ্ঠে বেশ কিছু কষে দিলে পাঁচনী দিয়ে, তখন সে বাড়ি থেকে পালিয়েও গেল না, কাঁদলেও না, কারুর কাছে কোনো অনুযোগও করলে না। সেইদিন রাত্রে চুন্নু ব্যাপারীর বাড়িতে আগুন লেগে গেল। আল্লারাখা সেই আগুনে সিগারেট ধরিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ধূম্র উদগিরণ করতে করতে যা বলে উঠল, তার মানে – আজ দিয়াশলাই কিনবার পয়সা ছিল না, ভাগ্যিস ঘরে তাদের আগুন লেগেছিল তাই সিগারেটটা ধরানো গেল!
তার বাবা যখন আল্লারাখাকে ধরে দুরমুশ-পেটা করে পিটোতে লাগল, সে তখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মার খেতে খেতে বলতে লাগল, যে, সকালে মার খেয়ে বড্ডো পিঠ ব্যথা করতেই তো সে পিঠে সেঁক দেবার জন্য ঘরে আগুন লাগিয়েছে! আজ আবার যদি পিঠে বেশি ব্যথা করে, পাড়ার কারুর ঘরে আগুন লাগিয়ে ও-ব্যথায় সেঁক দিতে হবে।
এই কবুল জবাব শুনে ওর বাবার যেটুকু মারবার হাত ছিল, তাও গেল ফুরিয়ে। সে ছেলের পায়ে মাথা কুটতে কুটতে বলতে লাগল, ‘তোর পায়ে পড়ি পোড়াকপ্যালা, হালার পো, ও-কম্মডা আর করিস নে, হক্কলেরে জেলে যাইবার অইবো যে!’ যাক, সেদিন গ্রামের লোকের মধ্যস্থতায় সন্ধি হয়ে গেল যে, অন্তত গ্রামের কল্যাণের জন্য ওর বাবা ওর বাবুয়ানার খরচটা চালাবে। আল্লারাখা গম্ভীর হয়ে সেদিন বলেছিল, ‘আমি বাপকা বেটা, যা কইবাম, তা না কইর্যা ছারতাম না!’ সকলে হেসে উঠল, এবং যে বাপের বেটা সে, সেই বাপ তখন ক্রোধে দুঃখে কেঁদে ফেলে ছেলেকে এক লাথিতে ভূমিসাৎ করে চিৎকার করে উঠল – ‘হুনছ নি হালার পোর কতা! হালার পো কয়, বাপকা বেডা! তোর বাপের মুহে মুতি!’ এবার আল্লারাখাও হেসে ফেললে।
যাক- যা বলছিলাম। ধোপ-দোরস্ত হয়ে আল্লারাখা অবলীলাক্রমে নারদ আলির উঠোনে গিয়া ঠেলে উঠে ডাকতে লাগল – ‘নারদ ফুফা, বারিত আছনি গো!’ এই চির পরিচিত গলার আওয়াজে বাড়ির তিনটি প্রাণী এক সাথে চমকে উঠল! চানের মা বলে উঠল, ‘উই শয়তানের বাচ্চাডা আইছে!’
চানভানু তখন দাওয়ায় বসে একরাশ পাকা করমচা নিয়ে বেশ করে নুন আর কাঁচা লঙ্কা ডলে পরিপূর্ণ তৃপ্তির সাথে টাকরায় টোকর দিতে দিতে তার সদ্ব্যবহার করছিল। সে তার টানা টানা চোখ দুটো বার দুয়েক পাকিয়ে আল্লারাখার তিন তেড়িকাটা চুলের দিকে কটাক্ষ করে বলে উঠল, ‘কেশরঞ্জন বাবু আইছেন গো, খাডুলিডা লইয়া আইও।’ বলেই সুর করে বলে উঠল –
‘এসো-কুডুম বইয়ো খাটে,
পা ধোও গ্যা নদীর ঘাটে,
পিঠ ভাঙবাম চেলা কাঠে!’
বলেই হি হি করে হেসে দৌড়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল।
আল্লারাখা এ অভিনব অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে রণে ভঙ্গ দিল। মোহনপুরের হানিফের এই প্রথম পরাজয়!
এ কথাটা চানভানুর মায়ের মুখ হতে মুখান্তরে ফিরে গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে গেল। এর পর থেকেই আল্লারাখাকে দেখলে, সকলে, বিশেষ করে মেয়েরা বলে উঠত – ‘উ-ই কেশরঞ্জন বাবু আইত্যাছেন!’
অপমান করলে চানভানু এবং আল্লারাখা তার শোধ তুললে সারা গাঁয়ের লোকের উপর। আল্লারাখা পান-সিগারেট খাইয়ে গাঁয়ের কয়েকটি ছেলেকে তালিম দিয়ে দিয়ে প্রায় তৈরি করে এনেছিল। তাদেরই সাহায্যে সে রাত্রে সে গ্রামের প্রায় সকল ঘরের দোরের সামনে যে সামগ্রী পরিবেশন করে এল, তা দেখলেই বমি আসে –শুঁকলে তো কথাই নেই!
গ্রামের লোক বহু গবেষণাতেও স্থির করতে পারলে না, অত কলেরার রুগি কোত্থেকে সে রাত্রে গ্রামে এসেছিল! তা ছাড়া তেঁতুলপাতা খেয়ে যে মানুষর বদহজম হয়, এও তাদের জানা ছিল না। গো-বর, নর-বর ও পচানী ঘাঁটার সাথে গাঁদাল পাতার সংমিশ্রণের হেতু না হয় বোঝা গেল; কিন্তু ও মিকশচারের সাথে তেঁতুল পাতার সম্পর্ক কী? কিন্তু এ রহস্য ভেদ করতে তাদের দেরি হল না, যখন তারা দেখল – আর সব দ্রব্য অল্প আয়েসে উঠে গেলেও তেঁতুলপাতা কিছুতেই দোর ছেড়ে উঠতে চাইল না! বহু সাধ্যসাধনায় বিফলকাম হয়ে দোরের মাটি শুদ্ধ কুপিয়ে তুলে যখন তিন্তিড়ি পত্রের হাত এড়ানো গেল, তখন সকলে একবাক্যে বললে – না ; ছেলের বুদ্ধি আছে বটে! তেঁতুল পাতার যে এত মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, তা সেদিন প্রথম গ্রামের লোক অবগত হল!
সারা গ্রামে মাত্র একটি বাড়ি সেদিন এই অপদেবতার হাত থেকে রেহাই পেল। সে চানভানুদের বাড়ি। নিজের বাড়িকেও যে রেহাই দেয়নি, সে-যে কেন বিশেষ করে চানভানুরই বাড়িকে – যার ওপর আক্রোশে ওর এই অপকর্ম – উপেক্ষা করলে, এর অর্থ বুঝতে অন্তত চানভানুর আর তার মা-র বাকি রইল না!
সে যেন বলতে চায় – দেখলে তো আমার প্রতাপ! ইচ্ছে করলেই তোমার অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারতাম, কিন্তু নিলাম না! তোমাকে ক্ষমা করলাম।
এই কথা ভাবতে ভাবতে পরদিন সকালে চানভানু হঠাৎ কেঁদে ফেললে! ক্রোধে অপমানে তার শুক্লপক্ষের চাঁদের মতো মুখ – কৃষ্ণপক্ষের উদয়-মুহূর্তের চাঁদের মতো রক্তাভ হয়ে উঠল। তার মা মেয়েকে কাঁদতে দেখে অস্থির হয়ে বলে উঠল, ‘চান’ কাঁদছিস কিয়ের ল্যাইগ্যা রে! তোর বাপে বকছে?’ চানভানুর বাপ-মায়ের একটি মাত্র সন্তান বলে যেমন আদুরে, তেমনই অভিমানী। তার মা মনে করলে ওর বাবা বুঝি মাঠে যাবার আগে মেয়েকে কোনো কারণে বকে গেছে।
চান আরো কেঁদে উঠে যা বলে উঠল তার মানে – কেন আল্লারাখা তাদের এ অপমান করবে। সকলের বাড়িতে অপকর্মের কীর্তি রেখে ওদেরে বাদ দিয়ে ও গ্রামবাসীকে জানাতে চায় সে ওদের উপেক্ষা করে – ক্ষমার্হ ওরা! এর চেয়ে ওর অপমান যে ঢের ভালো ছিল!
মা মেয়েকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝাল। কাল অমন করে ওকে অভ্যর্থনা করার দরুনই যে সে এসব করেছে তাও বললে। চানভানুর মন কিন্তু কিছুতেই আর প্রসন্ন হয়ে উঠল না। আল্লারাখা কাঁটার মতো তার মনে এসে বিঁধতে লাগল।
আল্লারাখা হানিফের মতোই তিরন্দাজ। তার প্রথম তির ঠিক জায়গায় গিয়ে বিঁধেছে।
সেদিন দুপুরে যখন চানভানু আরিয়লখাঁতে স্নান করতে যাচ্ছিল, তখন তার ম্লান মুখ দেখে আল্লারাখা যেমন বিজয়ের আনন্দে নেচে উঠল, তেমনই তার বুকে কাঁটার মতো কী একটা ব্যথা যেন খচ করে উঠল। আহা! ওর মুখ মলিন! নাঃ, চানভানুও সোনাভানের মতোই তির ছুঁড়তে জানে! তারও অলক্ষ্য লক্ষ্য ঠিক জায়গায় এসে বিঁধল!
আল্লারাখার চোখে চোখ পড়তেই ম্লানমুখী চানভানুর হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল। এ-হাসির জন্য সে একেবারে প্রস্তুত ছিল না। এত বড়ো শয়তানের এমন চুনিবিল্লির মতো মুখ। এতে যে মরা মানুষেরও হাসি পায়।
কিন্তু হেসেই সে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। এ-হাসির যদি আল্লারাখা অন্য মানে করে বসে। ছি ছি ছি ছি!
কিন্তু চানভানুকে এ-লজ্জার দায় বেশিক্ষণ পোহাতে হল না। ওর হাসির ছুরি একটু চিকচিকিয়ে উঠতেই আল্লারাখা রণে পৃষ্ঠভঙ্গ দিল। সে মনে করলে, এ-হাসির বিজলির পরেই বুঝি ভীষণ বজ্রপাত হবে! চান দেখতে পেল, অদূরে বিরাট বহুকালের পুরানো অশ্বত্থ গাছে আল্লারাখা তর তর করে উঠে একেবারে আগডালে গিয়ে বসল। কী ভীষণ ছেলে বাবা! ও গাছে যে সাপ আছে সবাই বলে! যদি সাপে কামড়ে দেয়, যদি ডাল ভেঙে পড়ে যায়! চানভানু খানিক দাঁড়িয়ে ওর কীর্তিকলাপ দেখে এই ভাবতে ভাবতে নদীর জলে স্নান করতে নামল।
নদীতে নেমেই তার মনে হল, ছি ছি, সে করেছে কী! কেন সে ওই বাঁদরটাকে অতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে! ও যে আস্কারা পেয়ে মাথায় চড়ে বসবে! না জানি সে এতক্ষণ কী মনে করছে!
তার আর সেদিন সাঁতার কাটা হল না। আরিয়লখাঁর জল আজ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল! চানভানু চুপ করে গলাজলে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আজ তার এই প্রশ্নই মনে বারে বারে উদয় হয়েছে – কেন আল্লারাখা ওদের বাড়ি কাল এমন করে গিয়েছিল! ও তো কারুর বাড়ির ভিতর সহজে যায় না। কেন সে ওকে দেখে অমন করে তাকিয়ে ছিল। তারপর সারা গাঁয়ের লোকের উপর অত্যাচার করে কেনই বা তার অপমানের প্রতিশোধ নিলে, ওকেই বা কিছু বললে না কেন! ও শুধু বাঁদর নয়, ও বুঝি পাগলও!
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে হল, সে বুঝি অশ্বত্থ গাছ থেকে তাকে দেখছে। অনেকটা দূরে অশ্বত্থ গাছটা। তবু সে স্পষ্ট দেখতে পেল, অশ্বত্থ গাছটার ওধারের ডাল থেকে কখন সে এধারের ডালে এসে ওরই দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। কী বালাই! চানভানুর মনে হতে লাগল, ও বুঝি আর কিছুতেই জল ছেড়ে উঠতে পারবে না! ওকে তো আরও কতবার দেখেছে, ওরই সামনে সাঁতরেওছে এই নদীতে ; কিন্তু এ লজ্জা – এ সংকোচ তো ছিল না ওর। কী কুক্ষণে কাল-সন্ধ্যায় সে ওদের বাড়িতে পা দিয়েছিল!
ও যেন কালবোশেখির মেঘের মতো, যত ভয় করে, তত দেখতেও ইচ্ছে করে!
এবারেও তাকে আল্লারাখা মুক্তি দিল। চানভানু দেখলে, আল্লারাখা গাছ থেকে নেমে যাচ্ছে।
এইবার তার ভীষণ রাগ হল ওই হতচ্ছাড়ার উপর। সে মনে করে কী। সে কি মনে করে, সে গাছে বসে থাকলে ও স্নান করে উঠে যেতে পারে না? তাই সে দয়া করে নেমে গেল! ও কি মনে করেছিল,পথে দাঁড়িয়ে থাকলে চানভানু আর নদীতে যেতেই পারবে না, ভয়ে লজ্জায়? তাই সে পথ ছেড়ে চলে গেছিল? চান নিষ্ফল আক্রোশে ফুলতে লাগল। আজ সে দেখিয়ে দেবে যে, যত বড়ো শয়তান হোক সে, তাকে চানভানু থোড়াই কেয়ার করে! জলের মধ্যে তার শরীর যেন জ্বলতে লাগল। তাড়াতাড়ি স্নান করে উঠে সে জোরে জোরে পথ চলতে লাগল। এবার যদি পথে দেখা পায় তার, তাহলে দেখিয়ে দেবে কেমন করে ওর নাকের তলা দিয়ে চান হনহনিয়ে চলে যেতে পারে। ওকে সে মানুষের মধ্যেই গণ্য করে না!
কিন্তু কোথাও কেশরঞ্জনবাবুর কেশাগ্রও সে দেখতে পেল না। এবারেও সেই অপমান, সেই দয়া? ওকে চান ঘৃণা করে – সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করে! কিন্তু একী, ওকে একটু অপমান করতে পারল না বলেই কি মনটা এমন হঠাৎ মলিন হয়ে উঠল? ওকে পথে দেখতে পেল না বলে মনটা ক্রমে অপ্রসন্ন হয়ে উঠল কেন? যে জোরে সে নদী থেকে আসছিল, পায়ের সে জোর গেল কোথায়? এ কী হল আজ চানের? ওর ঘাড়ে কি তবে ভূত চাপল?
পঞ্চশরের ঠাকুরটির শরে কেউটে সাপের মতোই হয়তো তীব্র বিষ মাখানো থাকে। শর বিঁধবা মাত্র এ বিষ সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীর ছেয়ে মাথায় গিয়ে ওঠে! নইলে এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে চানের অবস্থা এমন সঙিন হয়ে উঠত না। ওকে ভুলতেও পারে না, মনে করতেও শরীর রাগের জ্বালায় তপ্ত হয়ে ওঠে।
আজ প্রথম চানভানুর আহারে অরুচি হল। মা প্রমাদ গুনলে। আইবুড়ো মেয়ে বেশি বড়ো হলে কেন যে ভূতগ্রস্ত হয় – মা যেন আজ তা বুঝতে পারল। গোপনে চোখ মুছে মনে মনে বললে, ভূতে নজর দিয়েছে মা! – আর তোকে রাখা যাবে না, এইবার তোর মায়া কাটাতে হবে!
নারদ আলি আশ্চর্য হয়ে গেল, যখন তার বউ মেয়ের পাত্র-সন্ধানের জন্য বলল তাকে। কোনো কথা হল না, দুই জনারই চোখে জল গড়িয়ে পড়ল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন