১০০ মনীষীর জীবনী
হেনরিক ইবসেন
আধুনিক বাস্তবতাবাদী নাটকের জনক নাট্যকার, কবি ও মঞ্চনাটক পরিচালক হেনরিক যোহান ইবসেন ১৯০৬ সালের ২৩ মে ক্রিস্টিয়ানিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।
ইবসেনের ‘আ ডলস হাউস’ বিশ শতকে সবচেয়ে বেশিবার মঞ্চায়িত নাটক। তিনি পরবর্তীকালের জর্জ বানার্ড শ, অস্কার ওয়াইল্ড, আর্থার মিলার, জেমস জয়েস, ইউজিন ও’নিল এবং মিরোসলব করলিজার মতো বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও নাট্যকারদের প্রভাবিত করেছেন।
১৮২৮ সালের ২০ মার্চ নরওয়ের স্কিয়েনে জম্মগ্রহণ করেন। সচ্ছল ব্যবসায়ী পরিবারে ইবসেনের জন্ম। তার বাবা নুড ইবসেন ও মা ম্যারিচেন অ্যাটেনবার্গ। ইবসেনের জন্মের কিছুদিন পর পরিবারটির আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তার মা দুঃখে ধর্মে মনোনিবেশ করেন এবং বাবা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে তার রচিত চরিত্রগুলোর মাঝে তার বাবা-মায়ের ছায়া লক্ষ্য করা যায়।
১৫ বছর বয়সে ফার্মাসিস্ট হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে ছোট্ট শহর গ্রিমস্টাডে যান। সেখানেই তার নাটক লেখার সূত্রপাত। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ক্রিস্টিয়ানিয়ায় (বর্তমান অসলো) যান। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তখন নাটক রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় সাংবাদিকতা করে টুকটাক আয় করতে থাকেন। ১৮৫০ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘ক্যাটিলিনা’ ব্রাইনজুল্ফ বিজারম ছদ্মনামে প্রকাশ করেন। ওই বছর প্রথমবারের মতো মঞ্চায়িত হয় ‘দ্য বুরিয়াল মন্ড’। কিন্তু এটি দর্শক ও সমালোচকদের খুব একটা নজর কাড়তে পারেনি।
তার যুগে তার নাটককে রুচিশীল ভাবা হত না, কেননা তখন পারিবারিক জীবন ছিল ভিক্টোরীয় আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ আদর্শের বাইরে কিছু করাকে ভাল চোখে দেখা হত না। ইবসেনের কর্ম মানবচরিত্রের বিভিন্ন বাস্তব দিক সম্পর্কে কথা বলে।
ইবসেন আধুনিক মঞ্চনাটক প্রতিষ্ঠা করেছেন সামাজিক মূল্যবোধের বিভিন্ন উপাদানকে সমালোচকের দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করে। ভিক্টোরীয় যুগে নাটকগুলো কেবল সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে কথা বলবে এমন ভাবা হত; যেখানে সত্য সর্বদাই কালো শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে এবং সব নাটকই তৎকালীন সামাজিক মূল্যবোধের গুণগান গেয়ে শেষ হবে। ইবসেন এই ধারার বিপক্ষে যেয়ে নাটকের সমাপ্তিতে বৈচিত্র্য আনেন এবং নতুন ধারার জন্ম দেন। শেক্সপিয়ারের মতো ইবসেনকেও ইউরোপীয় ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পরে বার্গেনের একটি নরওয়েজীয় নাট্যগোষ্ঠীতে কয়েক বছর চাকরি করেন। সেখানে তিনি ১৪৫টিরও বেশি নাটকে নাট্যকার, পরিচালক এবং প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন। ১৮৫৮ সালে ক্রিস্টিয়ানিয়াতে ফিরে জাতীয় থিয়েটারের সৃজন পরিচালক নিযুক্ত হন। কিন্তু সময়টা ছিল আর্থিকভাবে হতাশাজনক।
১৮৬৪ সালে ক্রিস্টানিয়া ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ইতালি চলে যান। এরপর খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করা অবস্থায় ২৭ বছর পর তিনি দেশে ফিরেন।
১৮৬৫ সালে নাটক ‘ব্র্যান্ড’ তাকে খ্যাতি ও আর্থিক সফলতা এনে দেয়। এ সময় তার কাজকে অনেকে অস্তিত্ববাদী দার্শনিক কিয়েরকেগার্ডের দর্শনের সঙ্গে তুলনা করেন। পরের সময়গুলোকে বলা যায় ইবসেনের স্বর্ণযুগ।১৮৬৭ সালে তিনি প্রকাশ করেন পিয়ার গিন্ট, যেটির সুরারোপ করেছেন জনপ্রিয় সুরকার এডভার্ড গ্রেগ। যদিও ইবসেন আগেই ডেনীয় দার্শনিক কিয়েরকেগরের রচনার সাথে আগেই পরিচিত ছিলেন, তবুও তার ব্রান্ড নাটকের আগে তার প্রকাশ দেখা যায় নি। এরপর থেকে কিয়েরকেগরের আদর্শ নিয়ে তিনি গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন। প্রথমে তার বন্ধু জর্জ ব্রান্ডেস ইবসেনের সাথে কিয়েরকেগরের তুলনা করলে ইবসেন বিরক্ত হয়েছিলেন। ইবসেন পরে কিয়েরকেগরের রচনায় আকৃষ্ট হন এবং Either/Or ও ফিয়ার এন্ড ট্রেম্বলিং বই দুটি পড়েন। ইবসেনের পরবর্তী নাটক পিয়ার গিন্ট’ কিয়েরকেগরের সচেতন নজরে এসেছিল।
সাফল্যের সাথে সাথে ইবসেনের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তিনি নাটকে তার বিশ্বাস, বিচার ও চেতনার প্রকাশ ঘটাতে শুরু করেন। এই ধরনের নাটককে তিনি নাম দিয়েছেন “drama of ideas”। তার পরবর্তী নাটকের সিরিজকে ইবসেন নাটকের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে, যেখানে তার ক্ষমতা, সৃজনীশক্তি ও প্রভাবের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। এই ধরনের নাটক তখন ইউরোপে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।
এখানে তিনি তার প্রধান সাহিত্য কর্মগুলো রচনা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে এমপেরর এন্ড গ্যালিলিয়ান (১৮৭৩), যা রোমান শাসক জুলিয়ান দ্য অ্যাপোস্টেট এর জীবন ও সময় নিয়ে নির্মিত হয়েছে। যদিও ইবসেনের মতে তার সমস্ত নাটকের মধ্যে এটিকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতেন, তবুও অধিকাংশ সাহিত্যিকই তার সাথে দ্বিমত পোষণ করতেন। তার পরের সাহিত্যকর্মগুলো অনেক বেশি প্রশংসা কুড়িয়েছে।
১৮৭৫ সালে ইবসেন মিউনিখে চলে যান এবং এখান থেকে ১৮৭৯ সালে প্রকাশ করেন বিখ্যাত নাটক আ ডলস হাউস। এই নাটকে ভিক্টোরীয় যুগের বিয়েতে পুরুষ ও নারীর ভূমিকা তুলে ধরেন, যার জন্য তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। ১৮৭৫ সালে মিউনিখে চলে যান এবং সেখানে ১৮৭৯ সালে প্রকাশ করেন বিখ্যাত আ ডলস হাউস। পরবর্তীতে তার কপালে জুটে রাজকীয় নানা সম্মান। কিন্তু কোনোকিছুই তার বিষণ্নতা ঢাকতে পারেনি।
ইবসেন কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা ইউরোপীয় নাট্য ঐতিহ্যের বিপরীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার নাটকের প্রধান বিষয় ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার স্খলন ও সঙ্কট। প্রথমদিকে শুধু ব্যক্তি মানুষের সঙ্কট ঠাঁই পেলেও পরবর্তীতে অন্তর্ভুক্ত হয় ইতিহাস ও সমাজ কাঠামো। নাটকের মাধ্যমে তিনি প্রচলিত বিমূর্ত বিশ্বাস ও আচারগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানান। এ ছাড়া তার নাটকে রয়েছে পরাবাস্তব বিষয়াদি। যা আসলে দ্বন্দ্বময় বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। তার অন্যান্য বিখ্যাত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পিয়ার গিন্ট (১৮৬৭), গোস্টস (১৮৮১), অন এনিমি অফ দ্য পিপল (১৮৮২), দ্য ওয়াইল্ড ডাক (১৮৮৪), দ্য লেডি ফ্রম দ্য সি (১৮৮৮), হেডা গ্যাবলার (১৮৯০), হন গাব্রিয়েল বোর্কমান (১৮৯৬) এবং হোয়েন উই ডেড অ্যাওয়েকেন (১৮৯৯)। এ ছাড়া রয়েছে তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ডিজিতে (১৮৬২)।
তার বেশক’টি নাটক বাংলাদেশের অনুদিত ও মঞ্চায়িত হয়েছে। অনুদিত নাটকের মধ্যে বই আকারে পাওয়া যায়- আ ডলস হাউস, ওয়াইল্ড ডার্ক, এন এনিমি অব দ্য পিপল, রোজমারশোম, হেডা গ্যাবলার, জন গ্যাব্রিয়েল বোর্কম্যান এবং হোয়েন উই ডেড অ্যাওয়েকেন। এ ছাড়া তার নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জগদ্বিখ্যাত লেখক-নাট্যকার হেনরিক ইবসেন। একদিন সকালে ফুরফুরে মেজাজে নার্স এলো ইবসেনের বেডের পাশে রুটিন ভিজিটে। সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে উৎফুল্ল নার্স বললো, ‘হ্যালো মিস্টার গ্রেট রাইটার। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ।’ ইবসেন গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কিন্তু তোমরা যা বলো, সব সময় তা সঠিক হয় না।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন হেনরিক ইবসেন!