রবীন্দ্রনাথ এমনি এক সত্তা এবং প্রতিভা যাকে বাদ দিয়ে বাঙালিদের অন্য কোথাও যাওয়ার পথ নেই; বাঙালিকে বারবার তার কাছে ফিরে আসতে হয়। তিনি আছেন আমাদের মননে, চিন্তায়, সুখে, দুঃখে এমনকি মৃত্যুতেও। আমাদের ভাবনার এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ তার সুর সৃষ্টি করেননি। বাঙালির প্রতিটি সংগ্রামের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষভাবে তার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন। আমরা জানি বাঙালি মানেই রবীন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, সত্যজিৎ, জগদীশ চন্দ্র, জয়নুল, জসীমউদ্দীন এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু। এই মানুষগুলোকে বাদ দিলে বাঙালির আর বাঙালিত্ব থাকে না। রবীন্দ্রনাথ একাধারে যেমন কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সুরকার, শিল্পী, চিত্রকর ছিলেন; তেমনিভাবে তিনি একজন দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞান চিন্তক, সমাজবিজ্ঞানী ও আধুনিক কৃষিচাষের প্রবক্তা তা আজ সবার জানা। তিনি শুধু ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতিকে বিশ্বদরবারে পরিচিত ঘটিয়েছেন, পরবর্তীকালে সেই পথে এসেছেন অমর্ত্য সেন এবং ড. মুহম্মদ ইউনূস। আমরা এই সকল বাঙালির কাছে চিরঋণী। যুগে যুগে রবীন্দ্রনাথ এই বাঙালিকে সংকট মুহূর্তে পথ দেখিয়েছেন, অনেক বাঙালির কাছে তিনি হলেন জীবনদেবতা। যে কারণে রবীন্দ্রনাথ আজ খুব বেশি প্রাসঙ্গিক, তার বিবিধ কারণ ও ব্যাখ্যা রয়েছে, তিনি বিভিন্ন সময় পাশ্চাত্যে গিয়েছিলেন কিন্তু অন্যের উন্নত ভাবধারা শিখলেও বাঙালির চেতনাকে তিনি সমুন্নত রেখেছেন তার ভাবনায় এবং জীবনে। তিনি জানতে নয় জানাতে গিয়েছিলেন একজন বাঙালি কবির বিশ্বসমাজ দর্শন বিশ্ববাসীকে; চেতনায় আমরা কতটা উন্নত। তাই তিনি কবিগুরু এবং বিশ্বকবি; তার দর্শনে এবং সাহিত্যে সমগ্র পৃথিবীর সাহিত্যমনা মানুষ আজ মুগ্ধ। কবিগুরুর প্রতিটি গান ও কবিতা আমাদের চেতনায় অনুরণন তৈরি করে, আমরা জীবনের অনন্য স্বাদ খুঁজে পাই, জীবন কত মধুর ও আনন্দময়, তা উপলব্ধির অন্যতম পথ হলো রবীন্দ্রনাথকে জানা। তিনি একাই সমস্ত বাঙালির মনের সুখ, দুঃখের কথা গানে গানে আমাদের ভেতরে সৃষ্টি করেছেন এক অপার সৌন্দর্যে, মাধুর্যে এবং দর্শনে। কেউ কেউ তার গানকে আত্মজাগরণের এবং আত্মদীক্ষার গান বলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গানকে কবিতা হিসেবেও পড়া যায় আবার তার কবিতাও গান হয়ে গেছে, যেমন তার গীতিবিতানের অনেক গানই কবিতা। তার গানে বাণীর গুরুত্ব বেশি না সুরের গুরুত্ব বেশি সে নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে কিন্তু আমি মনে করি দুটোই সমান; সমানভাবে আমাদের আন্দোলিত করে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রথম থেকেই বাঙালির আগ্রহের শেষ নেই, সত্যিকার অর্থে একজন পূর্ণ মানুষ ছিলেন তিনি। বাঙালি সমাজ নানাভাবে রবীন্দ্রচর্চা করে আসছে, নিজের প্রয়োজনে, সমাজের প্রয়োজনে। আজ বিশ্ব যখন নানামাত্রিক সংকটে বিপন্ন, মনুষ্যত্ব ভূলুণ্ঠিত, ঠিক এই মুহূর্তে রবীন্দ্রচর্চা খুব বেশি প্রাসঙ্গিক, কেননা আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি কোনো মানুষ যদি রবীন্দ্রনাথের অন্তত ৩০%-৪০% রচনাবলি পাঠ করে এবং তার সুরের মূর্ছনায় হারিয়ে যায়, সে মানুষ যতই অসহিষ্ণু আর অমানবিক হোক না কে সে বদলে যাবে, তার ভেতরে আমূল পরিবর্তন হবে। সত্যিকার অর্থে মানুষ হওয়ার জন্যও সাহিত্য যেমন পাঠ করা উচিত আর সাহিত্য পাঠ করলে রবীন্দ্রনাথ পড়া উচিত। এই বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে রবীন্দ্রনাথের বিকল্প আর নেই; তিনি অতুলনীয়। আমরা যেমন পাহাড়ের কাছে যাই, নদীর কাছে যাই, সমুদ্রের কাছে যাই তথা প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে চাই, এটা হলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, তেমনি আমরাও রবীন্দ্রনাথের কাছে যাই; আমার কাছে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ এবং প্রকৃতি দুই মিলে যেন একাকার। তিনি সব সময় ধর্ম, বর্ণের ঊর্ধ্বে সবসময় বিশ্বমানবতার কথা বলেছেন। বর্তমান সময়ের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে যে সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথে আলো একমাত্র রবীন্দ্রনাথ হতে পারে অবলম্বন। তিনি বলেন- ‘মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন’; অতএব মনুষ্যত্ব যে ব্যক্তির আছে, তার দ্বারা সমাজের অমঙ্গল সম্ভব নয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ভেতর বোধ আর বিবেকটা থাকতে হবে আমি মনে করি শিক্ষার প্রাণ হলো ভেতরের আত্মউপলব্ধি, আর যার ভেতর এই উপলব্ধি তৈরি হয়েছে এবং নীরবে নিজের বিবেকের বাণী শুনতে পান, তার শিক্ষা কখন কুশিক্ষায় পরিণত হবে না। সুতরাং ভেতরের শিক্ষাটা খুব জরুরি, রবীন্দ্রনাথ আজীবন যেটা করেছেন, তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিল না কিন্তু প্রকৃতিপ্রদত্ত যে শিক্ষা ও জ্ঞান তৈরি হয়েছিল তা তিনি অর্জন করেছেন, পাঠের বাইরের তথাকথিত অপাঠ্য বই পড়ে। অতএব রবীন্দ্রনাথ পাঠ আমাদের কী পরিমাণ জরুরি তা বর্তমান সময়ে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক, যেহেতু মানবতার এবং মানবিকতার, মূল্যবোধের শিক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কবিগুরু এক সময় উপলব্ধি করলেন, শিল্প সাহিত্যে নয়, বাঙালিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে বিজ্ঞানচর্চা করতে হবে, তিনি রচনা করলেন বিশ্বপরিচয়, যেখানে তিনি তার বিজ্ঞানবিষয়ক ভাবনা তুলে ধরেছেন এবং বিশ্বপরিচয় বইটি উৎসর্গ করেছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। কবিগুরুর জীবদ্দশাতেই আধুনিক বিজ্ঞানের সব যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিল ইউরোপে, যা তৎকালীন সমাজকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছিল, রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার ইউরোপ ভ্রমণে গিয়ে সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে ইংরেজদের উপনিবেশ ভারতেবর্ষে তখন বিজ্ঞান ও আধুনিক শিক্ষাটা তেমনভাবে প্রসার লাভ করেনি এবং ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামোতে তা হওয়ার কথা নয়। এই অনুভব এবং ভাবনা কবিগুরু তার বিশ্বপরিচয় গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন- ‘বড় অরণ্যে গাছ তলায় শুকনো পাতা আপনি খসে পড়ে, তাতেই মাটিকে করে উর্বর। বিজ্ঞানচর্চার দেশে জ্ঞানের টুকরো জিনিসগুলি কেবলই ঝরে ঝরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে চিত্তভূমিতে বৈজ্ঞানিক উর্বরতার জীবধর্ম জেগে উঠতে থাকে। তারই অভাবে আমাদের মন আছে অবৈজ্ঞানিক হয়ে। এই দৈন্য কেবল বিদ্যার বিভাগে নয়, কাজের ক্ষেত্রে আমাদের অকৃতার্থ করে রাখছে।’
দেশের অন্যতম সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলম-এর সার্ধশতজন্মবর্ষে রবীন্দ্রনাথ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে কবিগুরুকে নিয়ে লেখা হয়েছে- ‘সাহিত্যের সকল শাখাকে রবীন্দ্রনাথ একক প্রচেষ্টায় সমৃদ্ধ করেছেন। সংগীতে তার দান বাঙালির পক্ষে অবিস্মরণীয়, অন্যদিকে পরিণত বয়সে চিত্রকলাচর্চায় বঙ্গীয় চিত্রধারার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে তিনিই তাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন। শিলাইদহ, পতিসর ও সাহজাদপুরে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে যে নতুন দৃষ্টি অর্জন করেছিলেন তা তার সমগ্র জীবনের সৃষ্টির ভুবনে, সাহিত্যসাধনায় ও মানসগঠনে ছাপ ফেলেছে। বাংলাদেশে ষাটের দশকের সূচনায় সামরিক সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা ও রবীন্দ্রনাথের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা ও তার সৃজন উৎকর্ষ সম্পর্কে নবীন উপলব্ধির জন্ম হয়েছিল। রবীন্দ্রসংস্কৃতির চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েই এই অঞ্চলের সকল বাঙালি আনন্দ-বেদনায়, সংকটে ও স্বপ্নে তাকে অবলম্বন করেছে। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ আমাদের মননে ও জীবনে নিত্যস্মরণীয় ও প্রাসঙ্গিক।’
বাঙালি ও রবীন্দ্রনাথ একসূত্রে গাথা; রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করলে বাঙালির বাঙালিত্ব থাকবে না।
--------লিটন মহন্ত
লেখক :: বিজ্ঞান গবেষক ও কথাসাহিত্যিক