বিশ্বকবি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধি ছিলেন?
বাজারে কিছু সস্তা মিথ প্রচলিত। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো, 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন।'
অমুক শুনেছেন তমুকের কাছে, তমুক শুনেছেন অমুকের নানার কাছে - এভাবেই কবিগুরুর ললাটে একটি মিথ্যে কলঙ্ক লেপন করা হয়েছে।
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এই অপবাদ খণ্ডন করা কর্তব্য।
২০০০ সালে ''আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’' নামে একটি বইয়ে মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন, বীরপ্রতীক, পিএসসি (তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) জানান, ”১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।”
তিনি অভিযোগ করেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ''কালি ও কলম'' পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য এজেডএম আব্দুল আলী একটি পত্রিকায় এই অভিযোগটির বিরোধিতা করেন।
তিনি বলেন, যারা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই অভিযোগটি করছেন তারা তাদের রচনায় কোনো সূত্রের উল্লেখ করেন নি। তবে ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে এই ধরনের একটি মনগড়া অভিযোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। মেজর জেনারেল (অবঃ) আব্দুল মতিন এই গ্রন্থ থেকেই তথ্যটি ব্যবহার করেছেন।
ঐ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোলকাতায়ই উপস্থিত ছিলেন না এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেননি। করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যেই ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হতো না। ১৯৩৬ সালে তাকে ডি-লিট উপাধি প্রদানের বিষয়েও বিরোধিতা হতো। অথচ তাঁকে দুবারই মুসলমান-হিন্দু সকল শ্রেণীর ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান আন্তরিকভাবে সম্মাননা প্রদান করেছে।
সর্বোপরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার সংবাদাদি সে সময়কার পত্রিপত্রিকায় পাওয়া যায়। কোথাও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় না।
মজার বিষয় হলো, ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ রবীন্দ্রনাথ কোলকাতায় ছিলেন না, ছিলেন শিলাইদহে। ১৯ মার্চ ১৯১২ (৬ চৈত্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) ভোরে কলকাতা থেকে সিটি অব প্যারিস জাহাজে রবীন্দ্রনাথ বিলেত যাত্রার জন্য কেবিন ভাড়া করেছিলেন। তার মালপত্রও জাহাজে উঠেছিল। সেদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তার যাত্রা স্থগিত হয়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন প্রফেসর রফিকুল ইসলাম। তিনি ''ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর'' নামে বই লিখেছেন। সেই বইয়ের কোথাও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায় না।
ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন জানান, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচারের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট বার্ষিক অধিবেশনের (২৮-২৯ জুন, ২০১১) আলোচনায় আসে।
অধ্যাপক ফকরুল আলমের কথার অংশ থেকে লিখছি…”রবীন্দ্রনাথ একসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিরোধী ছিলেন….কিন্তু….চার-পাঁচ বছর পর তার পুরানো পজিশন পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। অবশ্যই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গ্রহণ করেছেন বলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননায় এসেছিলেন। যারা ইতিহাসকে এক জায়গায় রেখে দেয় তারা ইতিহাসকে বিকৃত করে, তারা সত্যকে বিকৃত করে।….” (কার্যবিবরণী, পৃ:১৭৮)।
রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে লিখছেন, ''জাহাজ ছাড়বার আগের দিন রাত্রে স্যার আশুতোষ চৌধুরীর বাড়িতে বাবার নিমন্ত্রণ। কেবল খাওয়াদাওয়া নয়, সেই সঙ্গে বাল্মিকীপ্রতিভা অভিনয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। দিনেন্দ্রনাথ বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেন। অসুস্থ শরীরে বাবাকে অনেক রাত অবধি জাগতে হল। আমরা ঘরে ফিরলাম রাত করে। বাকি রাতটুকু বাবা না ঘুমিয়ে চিঠির পর চিঠি লিখে কাটিয়ে দিলেন। ভোরবেলা উঠে বাবার শরীরের অবস্থা দেখে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম, ক্লান্তিতে অবসাদে যেন ধুঁকছেন। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকতে হল।…জাহাজ আমাদের জিনিসপত্র সমেত যথাসময়ে পাড়ি দিল, কিন্তু আমাদের সে যাত্রা আর যাওয়া হল না।‘'
তথ্য বলছে, রবীন্দ্রনাথ ২৮ মার্চ কলকাতায় ছিলেন না, ছিলেন শিলাইদহে। তবে কি করে এতো বড় মিথ্যে তার নামে ছড়ালো?
বাঙলা সাহিত্যের দিকপাল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যখন কোনো শিক্ষিত, মার্জিত ভদ্রলোক এমন সন্দেহমূলক প্রশ্ন ছুড়ে দেন, তখন সত্যিই প্রশ্ন জাগে মনে, 'তারা কী আদৌও বাঙালী ছিলেন?
-------ইফতেখার উদ্দিন
লেখক : শিক্ষার্থী
বিবার্তা